অভিশপ্ত ফেব্রুয়ারি ফের একবার আঁচড় কাটল বাংলার সঙ্গীত দুনিয়ায়, চলে গেলেন বাংলা গানের কিংবদন্তি সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বর্ণযুগের শিল্পীদের সুরকার ছিলেন পন্ডিত অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। ষাটের দশক এবং সত্তর ও আশির দশকের বহু কালজয়ী গানের স্রষ্টা তিনি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্রসহ সেই সময়ের একাধিক শিল্পীর গান বেজে উঠেছিল তাঁর সুরে। বাংলা গানের সুরে আধুনিকতার এক অন্যতম পথিকৃৎ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। অসংখ্য, অজস্র উচ্চমানের এবং জনপ্রিয় গানের স্রষ্টা তিনি। সলিল চৌধুরীর সার্থক উত্তরসূরী তিনি। নিজস্ব স্বকীয়তায় এই মানুষটি সৃষ্টি করেছেন।
তাঁকে কেবল সুরকার পরিচয়ে আটকে রাখা যায় না, গীতিকার হিসেবেও তিনি উজ্জ্বল। একই সঙ্গে ওই সময়ের অন্যতম সফল পরিচালক তিনি। তাঁর সঙ্গীত পরিচালনায় গান গেয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁশলের মতো প্রবাদপ্রতিম শিল্পীরা। তাঁর সঙ্গীত পরিচালনায় অন্তর মন্দিরে জাগো, মেঘের সমুদ্দুরে, নিরুদ্দেশের পথিক, তিস্তা আমার, সূর্যের এক নাম বিবেকানন্দ অ্যালবামগুলো উল্লেখযোগ্য। তাঁর সুরারোপিত গানের মধ্যে আশা ভোঁসলের ও পাখি উড়ে আয়, সুবীর সেনের কণ্ঠে নয় থাকলে আরও কিছুক্ষণ, হৈমন্তী শুক্লার এখনও সারেঙ্গীটা বাজছের মতো গান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এমন একটা ঝড় উঠুক আর সবাই চলে গেছের মতো গান দুটি সুরকার অভিজিৎকে অমরত্ব দিয়ে গিয়েছে।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠ অনেক অরণ্য পার হয়ে, দিন চলে যায়, কেউ জানে না এসব তো কার্যত কালোত্তীর্ন হয়ে গিয়েছে, যতদিন বাংলা সঙ্গীত থাকবে ততদিন শ্রোতাদের স্মৃতিতে জীবন্ত থাকব অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে গাইয়েছেন কপালে সিঁদুর সিঁদুর টিপ পরেছো, তাপস পাল অভিনীত সাহেব ছবির কত স্বপ্ন-এর মত অসাধারণ সব গান। জীবন রহস্য ছবিতে মান্না দের গাওয়া কে তুমি, পৃথিবী তাকিয়ে দেখো, আশা ভোঁসলের যদি কানে কানে কিছু তো সুপার ডুপার হিট। হারায়ে খুঁজি ছবিতে অনুপ ঘোষালের গলায় ফুলে ফুলে বঁধু, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সে বলে সবুজ পাথর, আরতি মুখোপাধ্যায়ের টুংটাং পিয়ানোয় তো আজও সমান জনপ্রিয়।
আটের দশকে মৌন মুখর ছবিতে কিশোর কুমারকে দিয়ে গাওয়ানো সেই তানপুরা আছে ছিঁড়ে গেছে তার অভিজিৎবাবুর এক অসামান্য সৃষ্টি। রাজবধূ ছবিতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে গাওয়ানো আজু রঙ্গ খেলত মোর রঙ্গলাল তো বিদ্যাপতিকে মনে পড়ায়। একই ছবির অরুন্ধতি হোম চৌধুরীর ভেবেছিলাম 'ফুলের মত মাটির বুকে ধন্য হব'ও অনবদ্য। সেলাম মেমসাহেব ছবিতে মান্না দে'র 'ঝর্ণা ঝরঝরিয়ে' বা বেসিক রেকর্ডে হৈমন্তী শুক্লার এখনও সারেঙ্গিটা বাজছে কি ভোলা সম্ভব! সুবীর সেন আর তাঁর যুগলবন্দীতে সারাদিন তোমায় ভেবে, এ যেন সেই চোখ, জ্যোৎস্না ভেজা এই রাত এর মত কত, গান রয়েছে।
অ্যালবামের বেসিক গান হোক বা চলচ্চিত্রের সঙ্গীত; প্রতি ক্ষেত্রেই দাপটের সঙ্গে বিরাজ করেছেন পন্ডিত অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। সৃষ্টি করে গিয়েছেন অসামান্য সঙ্গীত। তাল ও লয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল অসামান্য, চিরাচরিত ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। প্রথা না ভেঙেও যে আধুনিক সঙ্গীত সৃষ্টি করা যায় তা দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন অভিজিৎ বাবু। জীবনের শেষ এক দশক তাঁর অনুরাগীরা সঙ্গীত দুনিয়ায় তাঁকে পাননি। তিনি নিজেও হয়ত আড়ালকে বেছে নিয়েছিলেন। এক সাক্ষাৎ সুর সাধকের জীবন কাটিয়ে তিনি চলে গেলেন নক্ষত্রলোকে...