মহারাষ্ট্রের নান্দেদ জেলার মাহুর গ্রাম। গ্রামের প্রাচীন নাম, ‘মাহুরগড়’। আরও প্রাচীন নাম, ‘মাতৃপুর’। কেননা, গ্রামের দুই কিলোমিটারের মধ্যেই রয়েছে সহ্যাদ্রি পর্বতশ্রেণির একাধিক পাহাড় ও টিলা। এরই একটিতে রয়েছে ‘রেণুকামাতার মন্দির’। রেণুকা, পরশুরামের মাতা; তিনি আরাধিত হন সমস্ত জগতের আদি মাতা তথা আদ্যাশক্তিরূপে। স্থানীয় ভক্তজনেরা তাঁকে ‘এলাম্মা’ অর্থাৎ ‘জগদম্বা’ নামে অভিহিত করেন। তিনি প্রাচীন সময় থেকেই মাতৃরূপে বন্দিত হন বলে, তাঁর কাছে বন্ধ্যা বা সাময়িক বন্ধ্যা নারীরা সন্তান চেয়ে মানত করেন; তাঁরা দেবীর ওপর আস্থা রাখেন এই ভেবে যে, মা হয়ে দেবী সন্তানের অভাবজনিত কষ্ট বোঝেন, তাই তিনি কারও কোল খালি রাখবেন না! যাঁদের মনস্কামনা পূর্ণ হয়, তাঁরা দেবীর দরবারে ছোট্ট দোলনা বেঁধে মানত পূরণ করেন।
রেণুকা মাতার পীঠস্থান অনেক প্রাচীন। প্রাচীন পুরাণগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘দেবী ভাগবতম্’ পুরাণে এই মন্দিরকে অত্যন্ত পবিত্র পুণ্যতীর্থ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘দেবী গীতা’ গ্রন্থে এই মন্দিরের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে, নির্দিষ্ট করা হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ শক্তিপীঠ হিসেবে। তাছাড়া রেণুকা মাতার এই পীঠস্থানকে একান্নপীঠের অন্যতম এক পীঠ হিসেবেও গণ্য করা হয়ে থাকে। কথিত আছে যে, এখানে ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে দেবী সতীর দেহাংশ পতিত হয়েছিল। তবে দেহের কোন অংশ পতিত হয়েছিল, তা জানা যায় না। আসলে, সমগ্র মহারাষ্ট্র জুড়ে তিনটি সতীপীঠ ও একটি উপপীঠের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয়; এদের একত্রে বলা হয় ‘সাড়ে তিন সতীপীঠ’। এই ‘সাড়ে তিন সতীপীঠ’-এর অন্যতম এক পীঠই হল মাহুরের মা রেণুকার মন্দির।
দেবী সতীর অঙ্গপতনের সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি কারণে এই মন্দিরকে সতীপীঠের মর্যাদা দেওয়া হয়; সেই কারণটি নিহিত আছে একটি পৌরাণিক কাহিনির মধ্যে। কাহিনিটি হলঃ
মাতা রেণুকা ছিলেন কুবজ রাজ্যের রাজকন্যা। তাঁর বিবাহ হয়েছিল ঋষি জমদগ্নির সঙ্গে। স্বয়ং ভগবান বিষ্ণু তাঁদের পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যে-সময়ের কথা বলছি, তখন মাতা রেণুকা পুত্রসহ ঋষির তপোবনে জপ-তপ ও অতিথিসেবার মতো পূণ্যকর্মের মধ্য দিয়ে পরম সুখে দিনাতিপাত করছিলেন।
তারই মধ্যে একদিন রাজা সহস্রার্জুন ভ্রমণ করতে করতে জমদগ্নির আশ্রমে এলেন। ঋষির অতিথি হলেন। আশ্রমে তখন পরশুরাম ছিলেন না। ঋষি জমদগ্নি ও রেণুকা উভয়ে ভাগ করে নিলেন অতিথিসেবার ভার। তাঁদের সেবা ও নিষ্ঠায় রাজা পরিতৃপ্ত তো হলেনই; সেই সঙ্গে চমৎকৃতও হলেন। নগরে যা সচরাচর পাওয়া যায় না; তা-ই দিয়ে এই অরণ্যবেষ্টিত তপোবনে ঋষি ও ঋষিপত্নী তাঁর আহার এবং আরামের আয়োজন করছেন। কিন্তু করছেন কী করে! এটা কীভাবে সম্ভব হচ্ছে, সেটা জানার তাঁর ভারি কৌতূহল হল। কৌতূহল চেপে না-রেখে তিনি ঋষিকে সহসা জিজ্ঞেস করে বসলেন, হে ঋষিশ্রেষ্ঠ জমদগ্নি, এ-সব দুর্লভ আয়োজন আপনি কীসের বলে সম্ভব করছেন?
সত্যচেতা ঋষি তখন স্মিত হেসে রাজাকে সত্যকথাই বললেন। গোশালায় নিয়ে গিয়ে একটি অতীব সুন্দর গাভীকে দেখিয়ে বললেন যে, গাভীটি দেবরাজ ইন্দ্রের দেওয়া কামধেনু। এর কাছে পার্থিব যা-কিছু চাওয়া হয়, গাভীটি তৎক্ষণাৎ তা দান করে। এ-কথা শুনে রাজার খুব লোভ হল। ভাবলেন, এই কামধেনু পেলে তিনি তো একাই ত্রিলোক জয় করতে পারবেন, কোন কিছুরই তো অভাব থাকবে না! উফ, এটা পেলে আর কী চাই! লোভ সংবরণের কোন চেষ্টা না-করে নীতি-ন্যায় কোন কিছুর বিবেচনা না-করে তিনি ঋষির কাছে গাভীটি চেয়ে বসলেন। কিন্তু ঋষি কিছুতেই গাভীটিকে হাতছাড়া করতে চাইলেন না।
ওদিকে বেপরোয়া রাজা চেয়ে যখন পেলেন না, তখন ছিনিয়ে নিতে চাইলেন। হাতে ধরলেন অস্ত্র। জমদগ্নি ঋষি হলেও শস্ত্রনিপুণ ছিলেন। তিনিও অস্ত্রধারণ করলেন রাজার অন্যায়ের প্রতিবাদে। শুরু হল ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। জমদগ্নি বীর হলেও রাজার ছল-কৌশলের সঙ্গে পেরে উঠলেন না। যুদ্ধে একসময় অস্ত্রের দারুণ আঘাতে জমদগ্নি মারা গেলেন। তাঁকে রক্ষা করতে গিয়ে রাজার হাতে রেণুকাও ভয়ানক আহত হলেন। তাঁর সর্বাঙ্গে যখন একুশখানা অস্ত্রের আঘাত থেকে রক্ত বেরোতে লাগল, তখন তিনি কামধেনুকে আদেশ দিলেন, হে ধেনু, এবার তুমি নিজেই নিজেকে রক্ষা করো। রেণুকার আদেশ পেয়ে কামধেনু আপন অঙ্গ থেকে অসংখ্য সশস্ত্র সৈন্যের আবির্ভাব ঘটাল, তাদের দোর্দণ্ডপ্রতাপে রাজা পরাজিত হয়ে পালিয়ে গেলেন।
এদিকে পরশুরাম বাড়িতে ফিরে যখন মৃত পিতাকে দেখলেন, আহত মাতাকে দেখলেন এবং মায়ের মুখে লোভী রাজার অন্যায়ের বিবরণ শুনলেন; তখন একইসঙ্গে দারুণ শোকে-দুঃখে-রাগে কাঁপতে কাঁপতে প্রতীজ্ঞা করলেন যে, ঐ পিতৃঘাতক রাজাকে হত্যা করে মায়ের আঘাতের প্রতিশোধ নিতে লোভী ক্ষত্রিয়শ্রেণিকে পৃথিবী থেকে একুশবার নিশ্চিহ্ন করবেন।
শোক কিছুটা স্তিমিত হলে মাতার আদেশে পরশুরাম পিতার মৃতদেহ দাহ করার জন্য সেখানে নিয়ে গেলেন, যেখানে কোনদিন কারও পা পড়েনি; এই স্থানটিই হল, মাহুরের পাহাড়চূড়া। এখানে তিনি পিতাকে দাহ করলেন। আর সেই চিতায় মাতা রেণুকা সতী হয়ে আত্মবিসর্জন দিলেন। এ-কারণেও মাহুরের পাহাড়চূড়ার পীঠস্থান ‘সতীপীঠ’-এর মর্যাদা পেল।
যাই হোক, এক চিতায় পিতামাতার সৎকারের পর উভয়ের বিয়োগব্যথায় কাতর হয়ে পরশুরাম যখন অঝোরধারায় কাঁদছিলেন; তখন বুঝি ভগবানের দয়া হল। হঠাৎ ভেসে এল দৈববাণী, সেই বাণীতে আকাশের দেবতা বললেন যে, চিতাতেই রেণুকা শেষ হয়ে যাননি, তিনি চিতার মাটি থেকে আবার আপন কায়া নিয়ে উঠে আসবেন; কিন্তু তিনি পূর্ণরূপে উঠে না-আসা অব্দি পরশুরাম যেন সে-দিকে না-তাকান! দেবতার আদেশ শিরোধার্য করে মায়ের আগমনের অপেক্ষায় মুখ ফিরিয়ে বসে রইলেন পরশুরাম। কিন্তু বহু ক্ষণ কেটে গেলেও মায়ের আগমনের কোন ইঙ্গিত তিনি পেলেন না। একসময় ধৈর্য হারালেন তিনি। বাধ ভেঙে সহসা তাকিয়ে ফেললেন চিতার দিকে। আর তাতেই সর্বনাশ হয়ে গেল। রেণুকার তখন সবে মাথাটুকু ভূমি থেকে উত্থিত হয়েছে, পুত্রের চাহনিতে সেটুকুই পাথর হয়ে গেল, রেণুকার আর পূর্ণ কায়ারূপে বাইরে আসা হল না! এ-কারণেই দেবীর মূর্তিটিকে বলা হয় স্বয়ম্ভূ মূর্তি।
দীর্ঘ সেই আকণ্ঠ প্রস্তরমূর্তিতেই রেণুকা পূজিতা হন। দেবীর সুগোল মুখমণ্ডল। সমগ্র মুখমণ্ডলে মেটে সিঁদুরের প্রলেপ। তাঁর স্ফীত নাশা। নাকের রঙ হলুদ। এই হলুদ রঙ কপাল অব্দি অদ্ভুত এক তিলকের মতো বিস্তৃত। নাকে নথ পরানোর ছিদ্র রয়েছে। তাতে পরানো রয়েছে সোনার নথ। কপালে সোনার টিকলি। টিকলির নীচে হলুদের ওপর মেটে সিঁদুরে লেখা ‘ওঁ’। নাকের নীচে সুগোল গহ্বরে মুখ নির্দিষ্ট হয়েছে। দেবীর টানা টানা দুই চোখ। দু’চোখে যেন কাজলের সজ্জা। তাঁর ভুরুজোড়া কিছুটা মোটা। দুই কান তাঁর দীর্ঘ, তাতে রয়েছে সোনার অলঙ্কার। দেবীর কপাল খুব প্রশস্ত নয়, তবু তা ঢেকে রয়েছে রুপোর বিশাল মুকুটে। দেবীর কণ্ঠে রয়েছে জয়মাল-চন্দ্রহার প্রভৃতি নামধারী একগুচ্ছ সোনার মালা। সবচেয়ে বড় কথা, এত ঐশ্বর্য ছাড়িয়ে দেবীর সমগ্র মুখমণ্ডলে যে অদ্ভুত এক প্রসন্নতা ও প্রশান্তি রয়েছে, তাতেই ভক্তের চোখ আটকে যায়, মন নিবিষ্ট হয়, অশান্ত মন শান্ত হয়ে ওঠে, নিরাশ্রয় হৃদয় আশ্রয় পায়। দেবীর মাথার পেছন ও কণ্ঠ বস্ত্র দিয়ে আচ্ছাদিত। মাথার ওপরে রয়েছে রত্নময় ছত্র। তাঁর কণ্ঠের কাছে বসে আছে একটি রত্ননির্মিত সিংহ। এই সিংহ-ই বুঝিয়ে দিচ্ছে দেবী আসলে, জগন্মাতা অম্বা, আদ্যাশক্তি দুর্গা। দেবীর বেদির ওপর রয়েছে রুপোর কারুকাজ করা অপরূপ সুন্দর মণ্ডপ।
মা রেণুকার মন্দিরটি যে পাহাড়ের ওপর রয়েছে, সেই স্থানটি ঘিরে রয়েছে গভীর অরণ্য। প্রাচীনকালে অরণ্য আরও দুর্গম ছিল, ছিল নানান বন্যপ্রাণীর নিশ্চিন্ত আবাসভূমি, এখনও কিছু বন্যপ্রাণী সেখানে রয়েছে। পাহাড়ের তলদশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চলেছে পবিত্রসলিলা নদী। দেবীর মন্দিরের নিকটেই রয়েছে ভগ্নপ্রায় মোহরগড় দুর্গ। দুর্গ ভগ্ন হলেও পাথরে নির্মিত মেটে সিঁদুরে রঞ্জিত দেবীর মন্দির বহু যুগ পেরিয়ে আজও অমলিন রয়েছে। ঐতিহাসিকদের অনুমান, মন্দিরটি দ্বাদশ শতকে দেবগিরির যাদবরাজ কর্তৃক নির্মিত হয়েছে। পরবর্তীকালে বাহমনি রাজাদের আমলে এবং পরবর্তী মুঘল আমলেও মন্দিরটি সযত্নে লালিত হয়েছে।
পাহাড়ের তলদেশ থেকে মন্দিরে যেতে কমবেশি আড়াইশোটি সিঁড়ি অতিক্রম করতে হয়। সিঁড়ি অতিক্রম করতে যাঁদের কষ্ট হয়, তাঁদের জন্য ডুলির ব্যবস্থা রয়েছে। মন্দিরের সামনে রয়েছে বিস্তৃত বাঁধানো প্রাঙ্গণ। মন্দিরের মাথায় রয়েছে গেরুয়া ধ্বজা। রয়েছে মেটে, হলুদ ও খয়েরি রঙে ডোরাকাটা অনুচ্চ চূড়া। মন্দিরপ্রাঙ্গণে দেবীর মূলমন্দিরের পাশে পাশে গণপতি, সিদ্ধেশ্বর, একনাথ, মল্লিকার্জুন, পরশুরাম প্রভৃতি দেবতাদের ছোট ছোট মন্দির রয়েছে।
এই মন্দিরের সবচেয়ে বড় উৎসব বিজয়া দশমী। এই সময় বেশ বড় একখানা মেলা বসে। ন’দিন ধরে দারুণ জাঁকজমকের সঙ্গে মহা আড়ম্বরে এই বার্ষিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। দেশ-বিদেশের অসংখ্য ভক্তজন তখন এই মন্দিরে ভিড় জমান। এছাড়া নবরাত্রি, দত্তাপূর্ণিমাও বেশ সাড়ম্বরে পালিত হয়। বছরের বিভিন্ন সময়ে আয়োজিত হয় বিশেষ পূজা, যাকে বলা হয় ‘মহাপূজা’। এই মন্দিরের একটি বিশেষত্ব হচ্ছে, এখানে আগত ভক্তজনদের মহাপ্রসাদ হিসেবে বিভিন্ন মশলা সহযোগে ছেঁচা পান দেওয়া হয়।...