জগন্নাথদেব মহাকাল। ভক্তদের বিশ্বাস তাঁর ইচ্ছেতেই প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি-সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করে। তাঁর ইচ্ছেতেই জগৎ চলেছে। তিনিই কালপুরুষ। একাধিক রূপ তাঁর। যখন সিংহাসনে আসীন থাকেন তখন নারায়ণ। নব কলবরে তিনি রুদ্রদেবতা। স্নান যাত্রায় গজানন। রথযাত্রায় সূর্যদেবতার প্রধান প্রতিনিধি। শয়নোৎসবে তিনি দেবী দুর্গা।
জগন্নাথের মহাপ্রসাদ ভক্তদের কাছে অমৃততুল্য। অপরিসীম তার গুরুত্ব। গঙ্গা–যমুনার জল দিয়ে তৈরি হয় এই ‘মহাপ্রসাদ’। জগন্নাথকে নিবেদন করা মহাপ্রসাদের আছে একাধিক গুণ। এই প্রসাদ কখনও স্পর্শদোষে অপবিত্র হয় না। মহাপ্রসাদ কখনও এঁটো হয় না। উচ্চ-নিচ ভেদ নেই। যেহেতু সবচেয়ে পবিত্র ভোগ তাই মুখে হাত দেওয়ার পর মুখ ধোয়ার প্রয়োজন হয় না। অনেকেই প্রসাদ ভক্ষণ করে হাত মাথায় মুছে নেন।
মাথায় হাত মুছে নেওয়ার একটি কাহিনিও শোনা যায়। ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে ওড়িশায় রাজত্ব করছেন রাজা মুকুন্দদেব। সেই সময় বঙ্গদেশের সুলতান সুলেমান কররানি রাজ্য আক্রমণ করেন। সুলতানপুত্র বায়াজিদ দুই সেনাপতি কালাপাহাড়, সিকন্দর উজবেক আর বিশান সেনা নিয়ে ওড়িশার সীমান্তে হামলা চালান। জাজপুরের থেকে চারমাইল দূরে গোহিরা টিকরি নামে এক স্থানে যুদ্ধে নৃপতি মুকুন্দদেব প্রাণ দেন। পুরীর ওপর আক্রমণ চালায় কালাপাহাড়।
১৫৬৮ থেকে ১৫৯২ পর্যন্ত টানা ২৪ বছর পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে জগন্নাথদেব, বলরাম ও সুভদ্রার কোনও বিগ্রহ ছিল না। আফগান অত্যাচারে পুজো পুরোপুরি বন্ধ। পরে খুরদার রাজা রামচন্দ্রদেব আকবরের সেনাপতি ও অর্থমন্ত্রী টোডরমলের সাহায্যে ওড়িশায় নতুন রাজ্য স্থাপন করেন। তিনিই ফের জগন্নাথবিগ্রহকে ফিরিয়ে আনেন মন্দিরে।
রাজা রামচন্দ্রদেব তাঁর রাজত্বের নবমতম বর্ষে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা ব্রহ্মকে কুজঙ্গগড় থেকে খুরদায় আসেন তিনি। এই উপলক্ষে এক বিরাট যজ্ঞের আয়োজন করেন।
শুভদিনে শুরু হয় তিন বিগ্রহের দারুমূর্তি নির্মাণ। দু বছর সময় লাগে। একাদশতম বর্ষে শ্রাবণী পূর্ণিমার নবম তিথিতে পুরীর মন্দিরের রত্ন সিংহাসনে নবনিরম্রিত দারুবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়। কুজঙ্গগড়ে পূজিত সেই ব্রহ্মগুলিই তিন বিগ্রহের বক্ষদেশে স্থাপন করা হয়। দেবতার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা হলেও মহাপ্রসাদ ‘সমুখুদি’ তখনও শুরু করা যায়নি। তিন দেবতাকে শুধুমাত্র শুকনো অন্নভোগ নিবেদন রা হত ।
ব্রাহ্মণ ও পণ্ডিতদের সঙ্গে আলোচনার পর চারমাস বাদে শ্রী মন্দিরের গর্ভগৃহে শুরু হয় অন্নভোগ নিবেদন।
রাজা রামচন্দ্রদেব নিজে অন্নরুপী মহাপ্রসাদ মাথায় নিয়ে জয়-বিজয় দ্বারের সিঁড়িতে দাঁড়ান। তাঁর কাছ থেকে প্রথম প্রসাদ গ্রহণ করেন তিন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত-রামচন্দ্র ভট্ট, গোবর্ধন প্রহরাজ এবঙ্গ মিশ্র গোঁসাই। মাটিতে বসে মহাপ্রসাদ গ্রহণের পর ওঁরা আর হাত ধোননি। শ্রদ্ধার সঙ্গে মাথায় ডান হাত মুছে নেন। তাঁদের দেখাদেখি বাকি ভক্তরাও একইভাবে প্রসাদ গ্রহণ করেন। সেই থেকেই মহাপ্রসাদ গ্রহণের পর ডান হাত মাথায় মুছে ফেলার রেওয়াজ শুরু হয়।