পাবনা জেলার ভাঙাবাড়ি গ্রামের বনেদি পরিবার, সেন পরিবার। সেই পরিবারে কবি ও সঙ্গীতকার রজনীকান্ত সেনের জন্ম। লোকে পরিবারটিকে আইনব্যবসায়ী পরিবার হিসেবেই জানত বেশি। কারণ, প্রথমে জ্যাঠা-বাবা-জ্যাঠতুতো দাদাদের মধ্যে কেউ মুন্সেফ হিসেবে আদালতে যোগ দিয়ে দিয়েছিলেন, কেউ বা সাব জজ হয়ে। রজনীকান্ত অবশ্য বেছে নিয়েছিলেন ওকালতির পেশা।
সেনবংশ ছিল পরম্পরায় শাক্ত। এবং পরিবারের সকলেই সংস্কৃতিমনস্ক; বিশেষ করে সঙ্গীতের প্রতি ছিল সকলের দুর্বলতা। বাড়িতে পুজোআচ্চা-উৎসব-অনুষ্ঠানে কীর্তন ও ভক্তিমূলক গানের আসর বসত। কান্তকবির বাবা গুরুপ্রসাদ পেশায় ছিলেন মুন্সেফ। তিনি কোনদিন প্রথাগতভাবে গান শেখেননি, কিন্তু, সঙ্গীতের প্রতি আজন্ম ভালোবাসার জন্যই তৈরি হয়েছিল কান, গড়ে উঠেছিল প্রবল সঙ্গীতবোধ। গলায় দারুণ সুর ছিল, অসাধারণ গাইতেন। ভক্তিসঙ্গীত গাইবার সময় তাঁর চোখ দিয়ে ভাবাবেশে দরদর করে গড়িয়ে পড়ত জলের ধারা। কীর্তন ও চণ্ডীর গান শুনে তিনি ভাবে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে কখনও নাচতেন, কখনও বা কোলাকুলি করতেন। নিজে গানও রচনা করতেন। বাংলা ১২৮৩ সালের বৈশাখ মাসে তাঁর গানের বই ‘পদচিন্তামণিমালা’ প্রকাশিত হয়। এমন বাপের ব্যাটা রজনীকান্ত সেন। ফলে, তিনি যে ভক্তিমূলক গানের ধারায় ‘তুমি নির্মল করো মঙ্গল করে’, ‘আমি অকৃতী অধম’, ‘আমি তো তোমারে চাহিনি জীবনে’-র মতো কালোত্তীর্ণ গান রচনা করে বঙ্গবাসীকে মাতিয়ে তুলবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী!
বাপের মতোই রজনীকান্তও প্রথাগতভাবে কোন ওস্তাদ-গুরুর কাছে নাড়া বেঁধে গান শেখেননি। গান ছিল তাঁর রক্তে। ছোটবেলা থেকেই বাঁশি বাজিয়ে সুর তুলতে পারতেন। তবে, সঙ্গীতপথে তিনি পেয়েছিলেন সুর-লোকের এক বন্ধুকে, সেই বন্ধুই তাঁকে সুরের জগতে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে। গুরুমুখী এ-বিদ্যায় গুরুর নাম যদি করতেই হয়, তাহলে বলতে হয় সেই বন্ধুটিরই নাম। তারকেশ্বর চক্রবর্তী--তিনি ছিলেন রজনীকান্তর চেয়ে চার বছরের বড়, তবুও বন্ধু—বন্ধু এবং গুরু। যে সময়ের কথা বলছি, তখন রজনীকান্তের বয়স চোদ্দ, তারকেশ্বরের আঠারো। তারকেশ্বরের একটি অসাধারণ গুণ ছিল, তিনি কবিওয়ালা ও পাঁচালিকারদের মতো গান রচনা করতে করতেই সুরসংযোজন করে টানা ঘণ্টা তিনেক গাইতে পারতেন। এই গুণের জন্যই রজনীকান্ত তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তাঁর অনুকরণে ও উৎসাহে তাৎক্ষণিকভাবে কোন বিষয়ে গীতরচনা করতে করতে সুরে গাওয়ার অভ্যেস করতেন। তারকেশ্বর অবশ্য তখন গুরুর কাছে নাড়া বেঁধে সঙ্গীতসাধনা করছিলেন। কিন্তু, যা শিখছিলেন--তাল, ফাঁকতাল, মাত্রা, লয়, রাগরাগিণী--সবই শিখিয়ে দিচ্ছিলেন রজনীকান্তকে। এভাবে অবিরত অভ্যাসে অল্পদিনেই রজনীকান্ত ছাড়িয়ে গেলেন বন্ধুকে। তবে, তারকেশ্বরের কাছে তাৎক্ষণিকভাবে গান রচনার যে শিক্ষা রজনীকান্ত পেয়েছিলেন, তা পরবর্তীকালে তাঁকে এগিয়ে যেতে প্রভূত সাহায্য করেছে।
অনেককাল পরের কথা। উকিল হিসেবে তখন রজনীকান্তের প্রসার বেড়েছে, সাময়িক পত্রিকায় তাঁর কবিতা ও গান প্রকাশিত হচ্ছে; আর ঠিক সে-সময়ই দেশে এলো স্বদেশি আন্দোলনের বান। বিদেশি বস্ত্র ও বিদেশি দ্রব্য বয়কটের ডাক। এইরকম পরিস্থিতিতে একদিন তিনি কলকাতায় এলেন। উঠলেন এসে, বন্ধু অক্ষয় সরকারের মেসে। অমনি মেসময় খবর রটে গেল--কান্তকবি হাজির! ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে মেসের ছেলেরা এসে তাঁকে ঘিরে ধরল। তাদের আবদার স্বদেশি আন্দোলনের জন্য দেশাত্মবোধক একটা গান লিখে দিতে হবে। রজনীকান্ত গানপাগল মানুষ। ফলে, গানের কথায় তাঁর শরীরে বেশ উত্তেজনা খেলে গেল, চোখ হয়ে উঠল উজ্জ্বল। তখন বেলা এগারোটা। টেনে নিলেন কাগজকলম। বেলা একটা নাগাদ গানের অন্তরা তৈরি হয়ে গেল—‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই...’। এইটুকু লিখে নিজেই বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। মনে হল, যা বলতে চান, সেটা ভালোভাবে জোরের সঙ্গেই বলতে পেরেছেন। ব্যস, উত্তেজনা চাপতে না-পেরে সেই অন্তরাখানা নিয়েই হাজির হলেন পরম সুহৃদ সাহিত্যিক জলধর সেনের কাছে। তিনি তখন "বসুমতী" অফিসে বসে। গানের অন্তরা পড়ে তিনি তো একেবারে আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন। আরে, এ গান নাকি, এ যে হীরের টুকরো! এ তো গর্ভধারিনী মায়ের সঙ্গে স্বদেশ মাকে নতুন করে বরণ করার মন্ত্র! তিনিও দারুণ উত্তেজিত। বললেন, এ গান এক্ষুনি ছাপব, গানের বাকি অংশটুকু কই? রজনীকান্ত লাজুক হেসে বললেন যে, প্রেসে অন্তরাটুকু কম্পোজ হতে হতে বাকি অংশটাও লিখে ফেলবেন। আর লিখলেনও তাই। ঘটাঘট শব্দে এক তাড়া কাগজে ছাপা হয়ে সে-গীতিকবিতা পৌঁছে গেল ছেলেদের হাতে। তাদের হাত থেকে লোক সাধারণের হাতে। বিকেল থেকেই স্বদেশি মিছিলে-পথে-ঘাটে-নৌকায় হাজার হাজার মানুষের কণ্ঠে শোনা যেতে লাগল—‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই...’। এই গান কান্তকবিকে অসম্ভব জনপ্রিয় করে তুলল, দিকে দিকে কবির নামে জয়ধ্বনি উঠল। সেই অভূতপূর্ব সম্মানে সেদিন কবি তৃপ্ত হলেন, আপ্লুত হলেন। তাঁর লেখা একটি চিঠিতে সেই তৃপ্ত মনের পরিচয়টি ধরা আছে : "আমার মনে পড়ে, যেদিন ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ গান লিখে দিলাম, আর এই কলিকাতার ছেলেরা আমাকে আগে করে প্রসেসন বের করে এই গান গাইতে গাইতে গেল, সেদিনের কথা মনে পড়ে আজও আমার চক্ষে জল আসে।"