১৯৪২ সাল। তখন হিটলারের গ্রাসে পোল্যান্ড। দেশজুড়ে চলেছে নাৎসিদের উন্মাদ তাণ্ডব। নিজেদের মাটি থেকে উৎখাত করে ইহুদিদের পাঠানো হচ্ছে কনসনট্রেশন ক্যাম্পে। অনাহার, অর্ধাহার, অমানসিক অত্যাচারে শেষ করে ফেলা হচ্ছে । এসব সহ্য করেও যারা বেঁচেবর্তে তাদের জায়গা গ্যাস চেম্বারে। চিমনি দিয়ে বেরিয়ে আসা গলগলে কালোয় ধোঁয়ার কোনও আর্তনাদ থাকে না। নাম নেই। পরিচয় নেই। অস্তিত্ব বলতে ডোরাকাটা পাজামা আর বন্দির নাম্বার।
পোল্যান্ডের ওয়ারশ শহর। সেখানে থাকতেন ইউনুশ কোরজাক। পেশায় শিশু চিকিৎসক। লেখক।
একটি অনাথ আশ্রম ছিল তাঁর। বেশ কিছু ছেলে মেয়ে থাকত সেখানে। শহর জুড়ে চলছে ইহুদি অভিযান। ইহুদীদের বন্দি করে পাঠানে হচ্ছে নাৎসি ক্যাম্পে। মূল শহর থেকে অনেকটা দূরে। উঁচু পাঁচিল ঘেরা একটা অন্ধকার জেলখানা। ভিতরে সামরিক নজরদারী। যেমন খুশি মানুষ মারা।
জাতিতে ইহুদী ইউনুশ কোরজাক জানতেন তাঁর এবং তাঁর শিশুদের পরিণতি কী। যে কোন দিন যেতে হবে মৃত্যুকূপে। ইহুদী হবার অপরাধে।
একদিন ডাক এল।
কিন্তু সেই অবোধ শিশুদের কী করে জানাবেন ক্যাম্পে যাবার খবর! শৈশবের খুশিতে তারা উচ্ছল! কী করে জানাবেন তাদের যে মৃত্যুর পরোয়ানা এসে গেছে! নিশ্চিত মৃত্যুর প্রস্তুতি কীভাবে নিতে হয় তাঁর জানা নেই!
প্রাচ্যের এক কবির নাটক পড়েছিলেন তিনি। সেখানে এক রাজার চিঠির অপেক্ষায় রোজ দিন গুনত এক অসুস্থ বালক তার নাম। অমল। নির্মল আনন্দে সে গ্রহণ করে মৃত্যুর চিঠি। মৃত্যুর হাহাকার, বিপন্নতার বিরুদ্ধে যেন এক প্রতিবাদ। অমলের আলোয় আলোকিত করতে চাইলেন অবোধ চোখগুলোতে।
সেই নাটক রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর। নাটকটি লিখেছিলেন তিনি ১৯১২তে। পরের বছরই ডব্লিউ.বি ইয়েটস তা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।
ইউনুশ কোরজাক তাঁর শিশুদের দিয়ে মঞ্চে ‘ডাকঘর’ নাটকের অভিনয় করলেন। পোলিশ ভাষায় ‘পোচতা’ । নাটকটি তিনি নিজে পোলিশ ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। যে শিশুদের কনসনট্রেশন ক্যাম্পের মৃত্যু শিবিরে চলে যেতে হবে সেই সব শিশুরা উজ্জ্বল মুখে জীবনকে ভালবাসার অভিনয় করে গেল মঞ্চে। চরম বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে জীবনকে ভালবাসার জেদ আসলে এক প্রতিবাদ। প্রাচ্যের নাট্যকারের দৃষ্টি দিয়ে সেই প্রতিবাদই করতে চেয়েছিলেন অসহায় শিশু চিকিৎসক। তিনি নিজে অভিনয় করেছিলেন রাজবৈদ্যের চরিত্রে।
১৯৪২ এর ১৮ জুলাই নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল। আর তার আড়াই সপ্তাহ পর ৬ আগস্ট নির্দেশ এল ১৯৫ জন শিশু আর সব সহকর্মীদের নিয়ে ট্রেবলনে নাৎসি ক্যাম্পে চলে যেতে হবে।
শহর দেখল কোরজাক তাঁর শিশুদের নিয়ে সার বেঁধে শহর ছেড়ে শবশিবিরের পথে চলে যাচ্ছেন। তারা শান্ত। ভয়হীন। আসন্ন বিপন্নতার কোন ভয় তাদের চোখে ছায়া ফেলেনি। মিছিলের সামনে ইউনুশ কোরজাক। আশ্রমের সব চেয়ে কনিষ্ঠ শিশুটি তাঁর কোলে। অন্য আর একজনের হাত কাঁধে...
ইউনুশ কোরজাক আর তাঁর শিশুদের আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি...