মা লক্ষ্মী হলেন অন্নের দেবী, সম্পদের দেবী। বাংলায় গোটা বছরজুড়ে নানান সময় দেবী লক্ষ্মী পূজিতা হন। ভাদ্র মাসের লক্ষ্মী পুজো, কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো, কার্তিক মাসে কালী পুজোর সময় লক্ষ্মী পুজো, পৌষ মাসের ব্রত, ফাল্গুন মাসের পুজো, চৈত্র মাসের পুজো ইত্যাদি রয়েইছে। তবে কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোই সর্বাধিক জনপ্রিয়। শরতে আশ্বিনের পূর্ণিমাকেই বলা হয় কোজাগরী। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে দেবী মর্তে আবির্ভূতা হন। আর তাই নিঃশব্দে চলে তাঁর আরাধনা সারা রাত জুড়ে। কোজাগর শব্দ থেকে নাকি এসেছে কোজাগরী। আবার অনেকের মতে 'কে জাগরী' বা 'কে জেগে আছে' থেকে এসেছে কোজাগরী আর এ থেকেই এসেছে কোজাগরী পূর্ণিমা। কো জাগতী – মানে নাকি 'কে জেগে আছো ?' হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ' বলছে, কোজাগর মানে কে জাগর অর্থাৎ এই পূর্ণিমায়কে জাগে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধান অনুযায়ী, এই তিথিতে লক্ষ্মী বলেন আজি নারিকেলের জল পান করিয়া কে জাগিয়া আছ, এস তাহাকে সম্পত্তি দান করিব। লোকবিশ্বাস, দেবীপক্ষের এই শেষ দিনে অর্থাৎ, কোজাগরী পূর্ণিমার দিন লক্ষ্মীদেবী তাঁর বাহন পেঁচার পিঠে চড়ে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন এবং দেখেন, কে কে সারারাত জেগে তাঁর পুজো করছে! যে জেগে থাকে, লক্ষ্মী তার বাড়িতেই অধিষ্ঠান করেন। শরৎ পূর্ণিমা তিথিটি আবার বিভিন্ন নামে পরিচিত। এই পূর্ণিমা তিথি কুমার পূর্ণিমা, কোজাগরী পূর্ণিমা, কৌমুদী পূর্ণিমা ইত্যাদি নামেও বিখ্যাত।
নীহাররঞ্জন রায় তাঁর বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন, 'আমাদের লক্ষ্মীর পৃথক মূর্তিপূজা খুব সুপ্রচলিত নয়। আমাদের লোকধর্মে লক্ষ্মীর আরও একটি পরিচয় আমরা জানি এবং তাঁহার পুজা বাঙালী সমাজে নারীদের মধ্যে বহুল প্রচলিত। এই লক্ষ্মী কৃষি সমাজের মানস কল্পনার সৃষ্টি, শস্য - প্রাচুর্যের এবং সমৃদ্ধির তিনি দেবী। এই লক্ষ্মীর পূজা ঘট লক্ষ্মী বা ধান্যশীর্ষপূর্ণ চিত্রাঙ্কত ঘটের পূজা।' এসবই এসেছে ওপার বাংলা থেকে, অধুনা আমরা কলাগাছে, কোথাও মাটির সরায়-পট, ধানের ছড়ায় দেবীকে কল্পনা করে পুজো করেন। কদম ফুলেও দেবীর আরাধনা করা হয়। কোথাও আবার থোড়ের তৈরি নৌকোতেও পুজো করা হয়।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার ব্রতকথায় লিখছেন দেবীপক্ষ শেষের পূর্ণিমাটি হল কোজাগরী পূর্ণিমা। ভক্তের বিশ্বাস ওইদিন কে জেগে আছেন? তা দেখতে দেবী আসেন। আশ্বিন পূর্ণিমায় যখন হৈমন্তিক শস্য ঘরে আসে, তখন এই ব্রত পালিত হয়। সন্ধ্যায় আয়োজিত এই পুজোয় সকাল থেকে আলপনায় সেজে ওঠে বাড়ি, লক্ষ্মীর পদচিহ্ন, লক্ষ্মীপেঁচা এবং ধানছড়া আঁকা হয়। এছাড়াও পদ্ম, ধানছড়া, কলমিলতা, দোপাটিলতা, লক্ষ্মীর পদচিহ্ন আঁকা হয়। বেড়ের মধ্যে একটি পূর্ণ ভাঁড় রাখা হয়। শুয়োরের দাঁত ও সিঁদুরের কৌটা রেখে তার উপরে নানারকম ফল ইত্যাদি সাজানো হয়। রচন পাত্রের গায়ে লক্ষ্মীর পদচিহ্ন ও ধানছড়া আঁকা হয় এবং তার উপরে লক্ষ্মীর সরা থাকে। তাতে লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, কালো রঙ ব্যবহার করে লক্ষ্মী নারায়ণ, লক্ষ্মীপেঁচার আলপনায় রাঙানো হয়।
লক্ষ্মী সরার উপরে আধখানা নারিকেলের মালা রাখা হয়, মেয়েরা এই মালাকে কুবেরের মাথা বা মাথার খুলি বলে। ওপার বাংলার যশোর অঞ্চলে একটি নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। সরার উপর একটি শীষ সমেত ডাব রাখা হয়। তাতে ঘোমটা দিয়ে, গহনা পরিয়ে সাজানো হয়। কলার খোল দিয়ে বের বানানো হয়, ধানের গোলার মতো কতগুলি ডোলা রাখা হয়। সেখানে নানাবিধ শস্য রাখা হয় যেমন ধান, তিল, মুগ, মুসুরি, মটর ইত্যাদি। লক্ষ্মী সাথে নারায়ণও পুজো পান। শস্যের দেবী হওয়ার কারণে লক্ষ্মীকে ধরিত্রী বা বসুমতী হিসেবে গণ্য করা হয়। বিষ্ণু পুরাণ অনুযায়ী, বরাহরূপী বিষ্ণু ধরিত্রী বা বসুমতীকে পত্নী রূপে গ্রহণ করছেন। অর্থাৎ, শস্যদায়িনী লক্ষ্মী এবং শস্যদেবী লক্ষ্মী উভয়ই এক এবং অদ্বিতীয়।
কোজাগরী পুজোর পদ্ধতিতে এপার বাংলায় এবং ওপার বাংলায় ফারাক দেখা যায়। পুজো উপচার ও নৈবেদ্য-ভোগেও থাকে পার্থক্য। এ বঙ্গের লক্ষ্মীপুজোয় সাধারণত ফলমূল, মিষ্টি আর বড়জোর লুচি ভোগ নিবেদন করা হয় কিন্তু ও বঙ্গের কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ নির্বিশেষে অন্নভোগ বা কোথাও কোথাও ইলিশমাছের পদও দেবীকে ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়ে থাকে। আলপনাতেও মাছের ব্যবহার দেখা যায়।
মাটির মূর্তি গড়ে, বা পূর্ণকলসে আমের পাতা দিয়ে তার ওপর কলসের মুখে বংশবৃদ্ধিমূলক উর্বরতা বিশ্বাসের প্রতীক ডাব বসিয়ে রেখে দেবীর পুজো করা হয়। অব্রাহ্মণ গৃহে লক্ষ্মীপট বসিয়ে পুজো করার রেওয়াজ রয়েছে। লক্ষ্মীপটে লক্ষ্মীর মূর্তি আঁকা থাকে। বঙ্গেই লক্ষ্মীপটের জন্ম। পাঁচালি, বাংলার লোকরচনা থেকে, পুজো মন্ত্রের জন্ম। লক্ষ্মীপট পুজোর অঙ্গ হল আনুষঙ্গিক অলঙ্করণ, অর্থাৎ আলপনা। চালের গুঁড়ো জলে গুলে আলপনা আঁকা হয়। পুজোর জায়গার চারদিকে এবং পুজোস্থলে যাওয়ার পথে আলপনা আঁকা হয়।
লক্ষ্মী সরা বা পট মূলত চাররকমের, তবে আনুষঙ্গিক বেশি রকমফের দেখা যায়। ঢাকাই সরা, ঢাকায় এর জন্ম হয়েছিল। এই সরার চারদিকের কিনারাগুলো উঁচু, মাঝের উত্তল অংশটি খুব বেশি উঁচু নয়। উপরিভাগে সাদা রঙের প্রলেপ দেওয়া থাকে। নারায়ণ ও লক্ষ্মীকে এই সরায় পরস্পরের মুখোমুখি দন্ডায়মান অবস্থায় দেখানো হয়। তাঁদের হাতে ধরা থাকে ফসলের শীষ। লক্ষ্মী তাঁর পদ্মাসনে থাকেন। তাঁর পায়ের কাছে থাকে রত্নাধার ও বাহন পেঁচা। ঢাকাই সরা নানা রকমের হয়। কোনওটায় জোড়া লক্ষ্মী থাকে, কোনওটিতে পাঁচ লক্ষ্মী, কোনওটাতে আবার লক্ষ্মীর সঙ্গে থাকেন চার সখী কিংবা রাধাকৃষ্ণ। ফরিদপুরী সরার জন্ম ফরিদপুর অঞ্চলে, এই সরার ধারগুলি উঁচু করা হয় না। অর্থাৎ এক্ষেত্রে শৈলীর তারতম্য রয়েছে। সুরেশ্বরী সরার উৎপত্তি ফরিদপুরের সুরেশ্বরে। গোলাকার সরার মধ্যভাগে থাকে দেবীমূর্তি। আজও কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো অনেকেই সরায় করেন। আগে ১৩ রকমের সরা তৈরি হত। এখন তা ৬ রকমে ঠেকেছে। একলক্ষ্মী সরায় লক্ষ্মীর দুপাশে পদ্ম, নীচে প্যাঁচা থাকে। সে আবার উড়ছে। তিন পুতুল সরাতে লক্ষ্মীর দুপাশে দুজন সখী থাকে। নীচে থাকে প্যাঁচা। এছাড়া রয়েছে গণকী, হিন্দু সমাজের তথাকথিত একেবারে নিম্নস্তরের লোকজন সাধারণত এই সরা বা লক্ষ্মীর পট ব্যবহার করেন। এই সরার পটভূমি ঘন লাল। লক্ষ্মীর পট বা সরা লোক ঐতিহ্যের ধারক। আসলে সরা গর্ভবতী নারীর প্রতীক। ফলত এর সঙ্গে উৎপাদনশীলতা ও সমৃদ্ধির যোগ রয়েছে।