জন্মদিনে ‘আন্ডারটোন’ অভিনেতা ফারুখ শেখ

অমিতাভ বচ্চন, রাজেশ খান্না, দেব আনন্দ- এঁদেরকে যেভাবে মানুষ মনে রাখেন, সেদিক দিয়ে 'ফারুখ শেখ' নামটা হয়ত অনেকেই মনে রাখেননি বা মনে রাখেননা, কারণ সাধারণত হিন্দি সিনেমার যে মূলধারা- বিশেষ করে সত্তর আশির দশকের যে ধরনের 'অ্যাকশন' ধর্মী সিনেমার রমরমা ছিল, সেই সময়েই প্রচলিত ধারার পাশাপাশি বহমান ভিন্নধারার অন্যতম যাত্রী ছিলেন ফারুক শেখ।

সত্তর ও আশির দশকের হিন্দি সিনেমায় তাঁর আন্ডারটোন’ অভিনয়ের জন্যই খ্যাতি পেয়েছিলেন এই অভিনেতা। তিনি মূলধারার দর্শকদের কাছে হয়ত সেভাবে বিখ্যাত নন, কারণ সেসময় তাঁর মত কিছু অভিনেতারা সিনেমায় 'হিরো' হওয়া ছাড়াও পার্শ্ব চরিত্রেও দাপিয়ে অভিনয় করা যায় তা বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন নির্ভিকভাবে। তিনি সব ধরনের দর্শকদের কাছে পৌঁছাতে পারেননি কারণ সেসময় অভিনয়-অভিনেতার থেকে 'স্টারডম'কেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত।

আজ তাঁকে নিয়ে এত কথা বলছি কারণ, আজ তাঁর জন্মদিন। আজ তাঁর এই বিশেষ দিনে রইল তাঁর সম্বন্ধেই দু'চার কথা-

ফারুখ শেখের কথা বললেই মনে পড়ে ‘তুমহারি অমৃতা’র কথা। ১৯৪৭ এর দেশবিভাগের পর বিছিন্ন প্রেমিক-প্রেমিকার পরস্পরকে দীর্ঘসময় ধরে লেখা চিঠির শ্রুতি নাটক ‘তুমহারি অমৃতা’। ফিরোজ আব্বাস খানের পরিচালনায় প্রেমিকা শাবানা আজমি আর প্রেমিক ফারুক শেখের অনবদ্য কণ্ঠ অভিনয়ে এই অসামান্য মঞ্চ প্রযোজনা দর্শক মনে রাখবে। উমরাও জান’ সিনেমায় রেখার বিপরীতে তরুণ প্রেমিক নবাব সাহেবের কথা কিংবা মৈত্রেয়ী দেবীর গল্প অবলম্বনে একপল’ সিনেমায় শাবানা আজমির বিপরীতে খামখেয়ালি তরুণ জিৎ বড়ুয়ার কথাও মনে রাখবেন যাঁরা অভিনয় অথবা 'অফবিট' ছবি ভালবাসেন।

১৯৯২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ‘তুমহারি অমৃতা’র মঞ্চায়ন হয়। দর্শকের বিপুল ভালোবাসাও পান ফারুক শেখ ও শাবানা আজমি। ২০০৪ সালে ‘তুমহারি অমৃতা’র একটি সিকুয়েল হয় আপকি সোনিয়া’ নামে। এতে মূল চরিত্রে ফারুক শেখের বিপরীতে ছিলেন সোনালি বেন্দ্রে।

গুজরাটের বরোদায় ১৯৪৮ সালের ২৫ মার্চ ফারুক শেখের জন্ম। বাবা মুস্তফা শেখ ছিলেন মুম্বাইয়ের আইনজীবী। মা- ফরিদা শেখ। বরোদার বরেলি শহরের কাছে এক জমিদারবাড়িতে ছিল তাদের পারিবারিক আবাস। ধন্যাঢ্য জমিদার পরিবারের সন্তান হওয়ায় বেশ বিলাসিতার মধ্যেই কাটে তাঁর শৈশব-কৈশোর। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। মুম্বাইয়ের সেইন্ট মেরি স্কুল এবং সেইন্ট জেভিয়ারস কলেজে পড়া শেষ করে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন।

ফারুক শেখের অভিনয় জীবন শুরু হয় মঞ্চে। এর পর সত্তর দশকের শুরুতেই বলিউডে প্রবেশ করেন। ১৯৭৩ সালে ‘গরম হাওয়া’-তে প্রধান অভিনেতা বলরাজ সাহানির সঙ্গে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। সিকন্দর মির্জা চরিত্রে তাঁর অভিনয় দর্শক ও সমালোচকদের নজর কেড়ে নেয়।

এরপর ভিন্নধারার চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান অভিনেতা হয়ে ওঠেন তিনি। নাসিরুদ্দিন শাহ, ফারুক শেখ, কুলভূষণ খারবান্দা, শাবানা আজমি, স্মিতা পাতিল, দীপ্তি নাভাল ছিলেন সে সময়ের অবাণিজ্যিক-'অফবিট' ধারার চলচ্চিত্রে জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী। লখনৌর শেষ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ'জীবন নিয়ে সত্যজিৎ রায় ১৯৭৭ সালে তৈরী করেন ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’, সেই সিনেমায় আকিল’-এর চরিত্রে ফারুক শেখের অনবদ্য অভিনয় তাঁকে আন্তর্জাতিক মানের খ্যাতি এনে দেয়।

বানিজ্যিক সিনেমাতেও তিনি সুনাম কুড়িয়েছিলেন। তাঁর অভিনীত নুরি’(১৯৭৯), ‘চাশমে বদ্দুর’(১৯৮১) ‘কিসিসে না ক্হনা, ‘বিবি হো তো অ্যায়সা’বক্স অফিসে সাফল্যও পায়। দীপ্তি নাভালের সঙ্গে তাঁর জুটি জনপ্রিয়তা পায় কমেডি মুভি 'কিসিসে না ক্হনা’র মাধ্যমে। তাঁর অভিনীত আরও কয়েকটি বহুচর্চিত সিনেমা- বাজার, ‘কথা, ‘আঞ্জুমান’ ইত্যাদি।

সত্যজিৎ রায়, মুজাফফর আলি, হৃষিকেশ মুখার্জি, কেতন মেহতা, ইয়াশ চোপড়ার মতো ভারতের নামজাদা পরিচালক-নিৰ্মাতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন ফারুক শেখ। চলচ্চিত্রে আবার তিনি ফিরে আসেন ২০০৮ সালে ‘সাস বহু অউর সেনসেক্স’ সিনেমার মাধ্যমে।

২০১০ সালে ‘লাহোর’ (২০০৯) সিনেমায় পার্শ্বচরিত্রে সেরা অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। রণবীর কাপুর ও দীপিকা পাড়ুকোন অভিনীত 'ইয়ে জাওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি' সিনেমায় রণবীরের বাবার ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখা যায় তাঁকে। তার অভিনীত সর্বশেষ সিনেমা ছিল ‘ক্লাব সিক্সটি’।

ফারুক শেখ কমেডি টিভি সিরিয়াল চমৎকার’সহ বেশ কয়েকটি সিরিয়ালে অভিনয় করেন এবং জনপ্রিয়তাও পান। নব্বই দশক ও নতুন শতাব্দীর দর্শকদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল মূলত টিভি অভিনেতা হিসেবে। সেলিব্রেটিদের নিয়ে বানানো টিভি শো ‘জিনা ইসিকা নাম হ্যায়’-তে তাঁর সাবলীল উপস্থাপনা টিভি দর্শকদের কাছে তাঁকে তুমুল জনপ্রিয় করে তোলে।

আশির দশক ও তার পরবর্তীকালে 'নাচ-গান-মারপিট'ধর্মী ছবিগুলোতে তিনি ছিলেন বেমানান। তাই বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র থেকে নিজেকে কিছুটা সরিয়েই আনেন তিনি। পরের দিকে বলিউডে যখন অন্যরকম ছবি করা শুরু হল, তিনি চেয়েছিলেন ফিরে আসতে। তবে আর ফিরে আসা হয়নি তাঁর। ২০১৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ফারুক শেখ।

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...