কালের কল্লোল- উৎপল দত্ত'র জন্মদিনে

চূড়ান্ত মানবিক বিপর্যয়ের যুগে 'ভদেভিল' বা খেমটা-খেউড়,  ম্যাজিক শো, মেলা, সিনেমা, থিয়েটার জাতীয় বিনোদনমূলক গণমাধ্যমের জগতে একসময় চাঁচাছোলা ঢুকে পড়েছিল প্রতিবাদী-বৈপ্লবিক ভাষা। সেই সময় নিখাদ বিনোদনমূলক পরিভাষাকে শান দিয়ে আরও ধারালো করে তুলেছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব উৎপল দত্ত। আজ তাঁর ৯০'তম জন্মদিন।

উৎপল দত্ত আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের ইতিহাসে অভিনেতা, নাট্যনির্দেশক ও নাট্যকার হিসেবে উজ্জ্বল এক কারিগর। তৎকালীন চলচ্চিত্র-সমাজ-রাজনৈতিক জগতেও তাঁর অবস্থান স্মরণীয়-উল্লেখযোগ্য। রাজনৈতিক দর্শনের দিক থেকে তিনি ছিলেন বামপন্থী ও মার্কসবাদী। তিনি নিজেই বার বার করে বলে গেছেন- "আমি শিল্পী নই। নাট্যকার বা অন্য যে কোনো আখ্যা লোকে আমাকে দিতে পারে। তবে আমি মনে করি আমি প্রপাগাণ্ডিস্ট। এটাই আমার মূল পরিচয়।" প্রচলিত বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া ছিল তাঁর প্রোপাগান্ডার বিষয়।

১৯২৯ সালের ২৯ মার্চ অবিভক্ত বাংলার বরিশালের কীর্তনখোলায় উৎপল দত্তের জন্ম। বাবা গিরিজারঞ্জন দত্ত ও মা শৈলবালা দত্ত। পড়াশোনা করেছেন শিলঙের এডমন্ডস স্কুলে, পরে কলকাতার সেন্ট লরেন্স, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। ১৯৪৮ সালে ইংরেজি অনার্স নিয়ে স্নাতক করেন তিনি। স্কুলজীবনেই বাবা-মায়ের সঙ্গে পেশাদারি থিয়েটার দেখা শুরু এ মানুষটির। এবং প্রথম দর্শনেই প্রেম, যার উক্তি পাওয়া যায় পরবর্তীকালে তাঁর কথায়- ‘সেই সব মহৎ কারবার দেখে মনে হলো, আমার পক্ষে অভিনেতা ছাড়া আর কিছুই হওয়ার নেই। আমার বয়স তখন তেরো।’

১৯৪৭ সালে নিকোলাই গোগোলের 'ডায়মণ্ড কাটসভ ডায়মণ্ড' এবং মলিয়েরের 'দ্য রোগারিজ অফ স্ক্যাপাঁ' দিয়েই তাঁর কলেজ জীবনের অভিনয় শুরু। নাটক দুটি প্রযোজনা করেছিলেন কলেজের ইংরেজি অ্যাকাডেমি এবং পরিচালনায় অধ্যাপক ফাদার উইভার। ক্রমশ উৎপল দত্ত ও কলেজের কয়েকজন সহপাঠী মিলে গড়ে তোলেন একটি নাট্যদল - 'দি অ্যামেচার শেক্স্পিয়ারিয়ান্স্' তাঁদের প্রথম উপস্থাপনা 'রোমিও অ্যাণ্ড জুলিয়েট' এবং ম্যাকবেথ নাটকের নির্বাচিত অংশ। সেই সময়েই, ১৯৪৭-এর অক্টোবরে, ইংলণ্ডের বিখ্যাত পরিচালক ও অভিনেতা জেফ্রি কেণ্ডাল তাঁর 'শেক্স্পিয়ারিয়ানা' নাট্যদল নিয়ে ভারত সফরে আসেন। কেণ্ডালের আহ্বানে উৎপল যোগ দেন সফররত সেই নাট্যদলে। ১৯৪৭-এর অক্টোবর থেকে জানুয়ারি ১৯৪৮ পর্যন্ত শেক্সপিয়ারিয়ানা নাট্যদল কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে তাদের প্রযোজনা মঞ্চস্থ করে। নাট্যমোদীরা অভিভূত হয়। জেফ্রি কেণ্ডালের দলে তখন উৎপল নিয়মিত অভিনয় করেছেন। ইউরোপীয় থিয়েটার দলের শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা উৎপলের নাট্যজীবনে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। কেণ্ডালের কাছেই শিখেছিলেন - There is no art without discipline and no discipline without sacrifice. তাঁর কাছেই উৎপল পেয়েছেন শেক্সপীয়রের নাটক অভিনয় করবার বিশেষ শিক্ষা।

১৯৪৭ সালে লিটল থিয়েটার গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করে শেকসপিয়র, বার্নাড শ, ক্লিফর্ড ওডেটস প্রমুখের নাটক ইংরেজিতে প্রযোজনা করতে করতেই সীমিত দর্শকসমাজের সীমাবদ্ধতায় বিব্রত হয়ে লিটল থিয়েটার গ্রুপকে (এলটিজি) বাংলা প্রযোজনার দিকে পরিচালিত করেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গেই বৃহত্তর দর্শক সমাজের কাছে পৌঁছানোর আন্তরিক আগ্রহে গণনাট্য সংঘেরাজনৈতিক পথ-নাটিকার ক্ষেত্রে গ্রহণ করেন অগ্রণী ভূমিকা। ১৯৫৯ সালে লিটল থিয়েটার গ্রুপ কর্তৃক মিনার্ভা থিয়েটার অধিগ্রহণ ও নিয়মিত নাট্যাভিনয়ের কর্মসূচি গ্রহণ এবং তাঁর পরিচালনায় তাঁরই লেখা অঙ্গার’, ‘ফেরারি ফৌজ’, ‘কল্লোল’ প্রভৃতি নাটকে রাজনৈতিক বোধ, আঙ্গিক প্রয়োগ- নাটক ও নাট্যাভিনয়ের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আবৃত্তিশিল্পী হিসেবেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তুরস্কের কবি নাজিম হিকমতের লেখা, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদেজেলখানার চিঠি’ কবিতার অসাধারণ আবেমথিত আবৃত্তি কানে ভাসে। সেই সাথে পদ্মা নদীর মাঝি’র হোসেন মিয়ার গায়ন, সুর সবেতেই তিনি ছিলেন তীব্র।

গ্রুপ থিয়েটার অঙ্গনের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের অন্যতম হিসেবে গণ্য করা হয় এই শিল্পীকে। এ ছাড়া ১৯৭১ সালে পিপলস লিটল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে টিনের তলোয়ার’ নাটক তাঁর একটি বড় পদক্ষেপ। কৌতুক অভিনেতা হিসেবেও তাঁর খ্যাতি রয়েছে। কৌতুক চলচ্চিত্র গুড্ডি, গোলমাল ও শৌখিন-এ অভিনয় করেছেন তিনি। তাঁর রাজনৈতিক নাটকগুলোর মধ্যে পাওয়া যায় শ্রেণিচেতনা, ইতিহাস চেতনা ও মধ্যবিত্ত চেতনা। ‘টিনের তলোয়ার’, ‘রাতের অতিথি’, ‘ছায়ানট’, ‘সূর্যশিকার’, ‘মানুষের অধিকার’ প্রভৃতি নাটকে যেমন পাওয়া যায় শ্রেণিসচেতনতা, তেমনি টোটা, ‘লাল দুর্গ’, ‘তিতুমীর’, ‘কল্লোল’, ‘দিল্লি চলো’, ‘ক্রুশবিদ্ধ কুবা’ প্রভৃতি নাটকের ইতিহাস চেতনা, অঙ্গার’, ‘ফেরারি ফৌজ’ প্রভৃতি নাটকের মধ্যবিত্ত চেতনা তাঁর নাটককে দেয় ভিন্নমাত্রা। নাটক, যাত্রাসহ বহু বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও ব্যাপক খ্যাতির অধিকারী হন উৎপল দত্ত। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় 'হীরক রাজার দেশে', 'জয় বাবা ফেলুনাথ কিংবা 'আগন্তুক'-এ, ঋত্বিক ঘটকের 'যুক্তি, তক্কো, গপ্পো'-এ, মৃণাল সেনের 'কোরাস', 'চালচিত্র', 'ভুবন সোম' সহ অসংখ্য চলচ্চিত্রে তাঁর অনন্য অভিনয়-প্রতিভা দেখেছেন বাংলার দর্শক।

কৃষকবিদ্রোহের নেতা তিতুমীরকে চব্বিশ পরগণার তৎকালীন ব্রিটিশ রেসিডেন্ট এজেন্ট এবং একজন গবেষক হিসেবে তিনি হাজির করেছিলেন তিতুমীর’ নাটকে। তিতুমীরের চোখে দেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামই ধর্মরক্ষা করার সংগ্রাম : ‘যার যা আছে সব কিছু দিয়ে দিতে হবে, তবেই সে এই সংগ্রামের প্রকৃত যোদ্ধার দায়িত্ব বহন করার উপযুক্ত হবে।’ তিনি ছিলেন কালের কল্লোল, সে প্রজন্মের 'তিতুমীর'। ১৯৯৩ সালের ১৯ আগস্ট কলকাতায় প্রয়াত হন তিনি।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...