আজীবন নিজেকে রেখেছিলেন শিক্ষার্থীর জায়গায়

বাবা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জগতে চেনা নাম। দীননাথ মঙ্গেশকর। একবার এক অনুষ্ঠানের জন্য আয়োজকরা এলেন দীননাথ মঙ্গেশকরের কাছে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে। পাশের ঘরেই ছিলেন ছোট্ট লতা। আয়োজনরা চলে যেতেই বাবার কাছে এসে আর্জি জানালেন বাবার সঙ্গে তিনিও গাইতে চান অনুষ্ঠানের মঞ্চে। বাবা তো ভীষণ অবাক! জিজ্ঞাস করলেন, “কী গাইবে তুমি?” কন্যার আত্মবিশ্বাসী উত্তর “রাগ খম্বাবতী”।

মেয়ের গলার আত্মবিশ্বাসের সুর ছুঁয়ে গিয়েছিল বাবাকেও। অনুমতি দিয়েছিলেন তিনি। মেয়ে লতার জীবনের প্রথম গুরুও বটে।সেই অনুষ্ঠানে এক সঙ্গে গান গেয়েছিলেন মঞ্চে।

কন্যার বয়স তখন মাত্র নয়। জীবনের প্রথম পেশাদারী মঞ্চে গান গাওয়া। বাবার মেয়ের গানে মুগ্ধ হয়েছিল তামাম শ্রোতা। পরের দিন খবরের কাগজে লেখা হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানের কথা। গোটা ঘটনাটাই ঘটেছিল কোনও পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই। যেন কেবল নিয়তির পথে।

সেদিনের সেই শিশুই দু’দশক পেরিয়ে হয়ে ওঠে এশিয়ার কোকিলকণ্ঠী। দীর্ঘ সাত দশকের পেশাদারী সঙ্গীত জীবন। মাঝখানের বছরগুলিতে কেবলই সাফল্যের দিকে এগিয়ে চলা। গানকে কখনও ‘কেরিয়ার’ হিসেবে ভাবেননি। গান ছিল তাঁর কাছে নিরন্তর সাধনা।

তাঁর প্রথম গুরু তাঁর বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর। বারো বছর বয়স পর্যন্ত পেয়েছিলেন তাঁকে। নিজের গানের খাতা আর তানপুরা মেয়েকে দিয়ে গিয়েছিলেন দীননাথ। মেয়ের মধ্যে দেখেছিলেন অমিত প্রতিভার আলো। জীবন মানে নিরলস শিখে চলা। তাই পিতার অকাল প্রয়াণে থেমে যায়নি সেই পথ। লতা ভর্তি হলেন ভিন্ডিবাজারওয়ালে আমান আলি খাঁ, দেওরস স্কুল ওফ মিউজিকে।

কঠোর অনুশীলন আর রেওয়াজে ডুবিয়ে রাখতেন নিজেকে। সাফল্যের চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছেও কখনও সেই রাস্তায় তিনি ক্লান্তিহীন। যতক্ষণ না সঙ্গীত পরিচালকের নিখুঁত মনে হয় ততক্ষণ বারবার অভ্যাস করে গিয়েছেন। রেকর্ডিং স্টুডিয়োতে এই ছিল তাঁর গান গাওয়ার দস্তুর।     

হিন্দি ছাড়াও প্রায় ৩৮ টি ভাষায় গান গেয়েছেন। গান, সুর, গায়কীর সঙ্গে সঙ্গে সেই ভাষার সঠিক উচ্চারণও তাঁর কাছে সমান জরুরি ছিল। কেরিয়ারের একেবারে শুরুর দিকে হিন্দিতে এসে যেত মারাঠি টান। গুলাম হায়দারের সঙ্গে ঠুমরি গাওয়ার সময় উর্দু উচ্চারণ সাবলীল করতে ৩২ বার টেক নিয়েছিলেন। হিন্দির পরেই সবচেয়ে বেশি গান গেয়েছেন বাংলা ভাষায়। বাঙালি বলয়ে থাকতেন। শুধু গান নয় ভাষা সংস্কৃতি, খাওয়াদাওয়া সবই ভালোবাসতেন নিয়ম করে শিখতে শুরু করেছিলেন বাংলাভাষা।

নিজের জীবনের প্রান্তসীমায় পৌঁছেও গানের গুরুদের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা এবং বিনয়ভাব ছিল শিক্ষনীয়। নিজের গুরুদের কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখতেন। ছবির গান থেকে শুরু করে খেয়াল, ঠুমরী, গজল, ভাগবতগীতি, ভজন এমনকি পপও গেয়েছেন। কিন্তু ভালোবেসেছেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকেই।

২০০১ সালে ভারতরত্ন পেতে তাঁর ঘনিষ্ঠ মানুষরা বলেছিলেন সব জয় করেছেন তিনি। কিন্তু নিজেকে আজীবন সঙ্গীতের একনিষ্ঠ ছাত্র হিসেবেই ভেবে এসেছিলেন। তাঁর নিজের কাছেও ছিল এটাই তাঁর পরিচয়।     

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...