অস্তরাগে রবীন্দ্রনাথ

ছোটবেলায় কিশলয়ের সেই কবিতাটা মনে আছে, 'গলদা চিংড়ি তিংড়ি মিংড়ি/লম্বা দাঁড়ার করতাল'!
কবিতাটার সঙ্গে জড়িয়ে শৈশবের কতই না সবুজ আনন্দ। কিন্তু কে জানত যে, এই ছড়া রবীন্দ্রনাথ যখন লিখছে্‌ন, তখন তাঁর জীবনপ্রদীপ নিভতে বসেছে।
ইউরিনের অসহ্য কষ্ট, গায়ে জ্বর, মাথায় যন্ত্রণা।
লিখছেন একটার পর একটা হালকা মেজাজের ছড়া। সেটাই তাঁর মানসিক বিশ্রাম। কালিম্পং থেকে অসুস্থ অবস্থায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ফিরে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ। বিছানায় উঠে বসার মতো অবস্থা নেই।
এমন সময় এল ভ্রাতৃদ্বিতীয়া।
রবি ঠাকুরের দিদি বর্ণকুমারী দেবী তখনও জীবিত। তিনি এলেন আশি বছরের ভাইকে ফোঁটা দিতে। ভাইয়ের কপালে ফোঁটা এঁকে দিয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, 'দেখো রবি তোমার এখন বয়স হয়েছে, এক জায়গায় বসে থাকবে, অমন ছুটে ছুটে আর পাহাড়ে যাবে না কখনও। বুঝলে?'
রবি ঠাকুরও গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বললেন, ‘কখনও আর ছুটে ছুটে যাব না; বসে বসে যাব এবার থেকে।’সকলের খিলখিল হাসিতে ঘর ভরে গেল। মৃত্যুশয্যাতেও তাঁর রসবোধে কোনও ছেদ পড়েনি।
তারপর এলেন শান্তিনিকেতনে। কিছুদিন আগেই জীবনের শেষ ২৫ বৈশাখ কাটিয়েছেন কবি। প্রস্টেটের কারণে কষ্ট পাচ্ছেন। বড় ক্লান্ত, বড় শ্রান্ত। রোগে জীর্ণ দেহটাকে যেন কিছুতেই আর টানতে পারছেন না। চিন্তার ধারাও বড় ঝাপসা হয়ে আসে। আর এটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের সব চাইতে বড় কষ্ট।
স্রষ্টাকে সৃষ্টির আনন্দ থেকে বঞ্চিত করছে তাঁর এই ব্যাধি। তাই তিনি চেয়েছিলেন যেকোনও উপায়ে রোগ থেকে মুক্ত হয়ে আবার যেন লেখালিখি করতে পারেন।
অপারেশনে ছিল তাঁর প্রবল অনীহা। ওদিকে ডাঃ নীলরতন সরকার ও ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের নির্দেশে তাঁর অ্যালোপেথি চিকিৎসা চলছে। কিন্তু কবিরাজি চিকিৎসার প্রতি কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ দুজনেরই বিশেষ আগ্রহ ছিল। ডাঃ রাম অধিকারী কবিরাজি চিকিৎসা শুরু করলেও কবির স্বাস্থ্যের কোনও উন্নতি হল না। অবস্থার অবনতি হওয়ায় অপারেশনই যে একমাত্র পথ সেটা বুঝতে রবি ঠাকুরেরও অসুবিধে হয়নি।
৯ শ্রাবণ। দুয়ারে প্রস্তুত হল গাড়ি। কবিকে অপারেশনের জন্য আনা হবে জোড়াসাঁকোয়। ধীরে ধীরে আশ্রমের নীল বাসে তোলা হল তাঁকে। শেষবারের মত বুক ভরে নিলেন শান্তিনিকেতনের বাতাস। পেছনে পড়ে রইল তাঁর স্বপ্নমাখা শান্তিনিকেতন।
যে পাথরের ঘরে তাঁর জন্ম হয়েছিল সেখানেই স্ট্রেচারে করে আনা হল তাঁকে। ৩০ জুলাই অপারেশন হল কবির অনিচ্ছাতেই। প্রস্টেট কাটা নয়, শুধু একটা জায়গা ফুটো করে ইউরিন বেরোনোর রাস্তা করে দেওয়া। কিন্তু সেটাই কাল হল।
পেনিসিলিনের মতো অ্যান্টিবায়োটিক তখনও আবিষ্কার হয়নি। সারা শরীরে ইউরেমিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা। বিধান রায়, ও নীলরতন সরকার এলেন। কিন্তু তাঁদের মত কিংবদন্তী ডাক্তারও যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দিতে পারলেন না কবিকে। রাত্তিরে কাশি আর হিক্কা প্রবল জোরে হতে লাগল। রাখি পূর্ণিমার জোয়ারে তখন ভাসছে বিশ্বচরাচর।
বাইশে শ্রাবণ সকাল। পায়ের কাছে সাদা শালের ওপর ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে চাঁপা ফুল।
অমিতা ঠাকুর মুখে জল দিচ্ছেন। কবির গোটা শরীর কেমন যেন বেঁকে বেঁকে যাচ্ছে। কানের কাছে মন্ত্রচ্চারণ হচ্ছে- শান্তম্শিবম্অদ্বৈতম্। বেলা ন'টায় অক্সিজেন দেওয়া শুরু হল। নাড়ীর গতি ক্ষীণ। বাইরে থেকে ভেসে আসছে মৃদুকণ্ঠের গান-'কে যায় অমৃতধাম যাত্রী'।
দুপুর ১২টা ১০ মিনিট। সব স্তব্ধ হয়ে গেল। দীপ্ত দ্বিপ্রহরে মহাকবির মহানির্বাণ। অগণিত মানুষের চোখের জলে লেখা হয়ে রইল বাইশে শ্রাবণের ইতিহাস।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...