সম্মান জ্ঞাপনে বিশাল দরজা!

প্রাচীন বঙ্গের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় মালদা এবং তার আশেপাশের সমগ্র অঞ্চলটি গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনস্ত পুণ্ড্রবর্ধন নামে পরিচিত ছিল। এরপর সপ্তম শতকে প্রথম স্বাধীন বাঙালি রাজা শশাঙ্কের আমলে তা গৌড় হিসেবে পরিচিতি পায়। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে পাল রাজাদের সময় থেকে বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়। সেন রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালে শহরটির নাম হয় লক্ষ্মণাবতী। স্বাধীনতার পর  মালদা জেলায় ভারত আর বাংলাদেশের সীমান্তে রয়েছে ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রাচীন শহর গৌড়। দুর্গ শহরটির কিছু অংশ পড়েছে বাংলাদেশের চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলাতেও।

                       ১২০৫ সালে ইখতিয়ারউদ্দিন বখতিয়ার খিলজি নদিয়া আক্রমণ করেন। রাজা লক্ষ্মণসেন রাজপ্রাসাদের পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান বিক্রমপুরের দিকে। আর বখতিয়ার খিলজি লক্ষ্মণাবতী দখল করে সেই জায়গাটিকেই নিজের রাজধানী করেন যদিও তা পরিচিত হয় লখনৌতি নামে। ১৩৫০ থেকে রাজধানী কিছুদিনের জন্য পান্ডুয়ায় স্থানান্তরিত হলেও ১৪৫৩ সালে আবার স্বমহিমায় ফিরে আসে গৌড়ে, এবং শহরটির নামকরণ হয় জান্নাতাবাদ। পরবর্তী প্রায় তিনশ বছর ধরে তুর্কি সুলতানরা গৌড়কে তাদের ক্ষমতার প্রাণকেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। মুঘল শাসকদের আমলেও এখানে গড়ে উঠেছিল অসাধারণ সব স্থাপত্য। লুকোচুরি দরওয়াজা, লোটন মসজিদ, বড়ো সোনা মসজিদ, দাখিল দরওয়াজা, লোটন মসজিদ, কদম রসুল মসজিদ, ফিরোজ মিনার, গুমতি দরওয়াজা, ফতেহ খানের সমাধি – সমস্ত মধ্যযুগ ধরে এখানে স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে শোভিত হয়েছে। কালের নিরিখেই এই সব স্থাপত্যে লেগেছে লেগেছে ক্ষয়ের রং, তবুও আজও মুগ্ধতার ভাটা পড়েনি তাতে।

             দাখিল দরওয়াজা এর মধ্যেই অন্যতম। অনেকে ভাবতেই পারেন দরজার মধ্যেই আবার নতুনত্ব কি থাকবে? তাদের জন্য এই তথ্য। শোনা যায় গৌড় দুর্গ বানানোর সময় সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ এই দাখিল দরোয়াজা তৈরি করিয়েছিলেন। তবে ঐতিহাসিকদের মতে এরকম সুদৃঢ় এক স্থাপত্য বানানোর পরিকাঠামো নাসিরউদ্দিন মাহমুদের সময়ে ছিল না। এই পরিশীলিত সৌধ তৈরিতে যে উন্নত স্থাপত্যবিদ্যার প্রয়োজন সেটা নাসির পরবর্তী ইলিয়াস শাহি যুগেও চোখে পড়ে না। তাই এক্ষেত্রে একমাত্র হোসেন শাহি আমলেই দাখিল দরোয়াজা নির্মাণ সম্ভব বলে  অনুমান করা যায়। বড়ো সোনা মসজিদের সঙ্গে দাখিল দরোয়াজার সাজসজ্জায় অনেক মিল রয়েছে। হতে পারে, বড়ো সোনা মসজিদ যিনি তৈরি করেছিলেন, সেই আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আদেশেই দাখিল দরোয়াজা বানানো হয়েছিল। এতো গেলো নির্মাণ রহস্য যা ঐতিহাসিক কালের নিয়মে আজ বিতর্কের উর্ধে নয়। এবার আসি ব্যাখ্যায়।

            আরবি ভাষায় দাখিল’ শব্দের অর্থ ‘প্রবেশ’ আর ফারসি ভাষায় ‘দরওয়াজা’ মানে ফটক। অর্থাৎ গৌড় দুর্গে ঢুকতে হত এই দাখিল দরোয়াজা দিয়ে। দুর্গে যাওয়ার প্রধান ফটক ছিল এটাই। ৬০ ফুট উঁচু আর ৪২ ফুট চওড়া ফটকের ভেতরে প্রবেশপথটা ছিল বেশ বড়োসড়ো। সুলতান বা অভিজাত শ্রেণির কেউ যখন দাখিল দরোয়াজা দিয়ে দুর্গে ঢুকতেন ফটকের দুপাশ থেকে কামান দেগে তাকে জানানো হত সম্মান। এই সৃষ্টির আরেক নাম তাই সেলামি দরোয়াজা’ নাম খ্যাত। কিন্তু কালের গতিতে অবক্ষয়ের রং লাগলেও আজও এই তাৎপর্যশালী দরজা ঐতিহাসিক তাৎপর্য বহন করে চলেছে।

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...