উপমহাদেশের ব্যাটসম্যানরা স্পিনটা ভালোই খেলেন। ভারত এতে সেরা। এখন বিরাট রোহিতের ভারত আবার পেস বলটাও দারুন খেলছে। ষাটের দশকে কয়েকজন বাদে পেস বল খেলতে সমস্যা হতো। কিন্তু ওই সময়ে একজন বিদেশি স্পিনার এসে ভারতের ব্যাটিং লাইন-আপকে কুপোকাত করে দেবে, কেউ ভাবেনি। ভেবেছিলেন ল্যান্স গিবস নিজে।
বার্বাডোজের পঞ্চম দিনের উইকেটে বল পড়ে একটু স্কোয়ার টার্ন করতে করতে শুরু করেছিল। দীর্ঘদেহী স্পিনার গিবস, নিজের উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে স্পিন এন্ড বাউন্স তৈরি করলেন। এতেই কাত পতৌদি থেকে সারদেশাই। একসময় যে টেস্টে ভালো জায়গায় ছিল ভারত। ভালো বলতে ভারত ম্যাচ প্রায় বাঁচিয়ে নিয়েছিল , ওই সময়ে টেস্ট জেতার চেয়ে ম্যাচ বাঁচানো বড় কৃতিত্ব ছিল। জিতলে পোয়া বারো। তো এমন টেস্ট বাঁচাতে গিয়ে বিশ্রীভাবে হেরে গেল ভারত। সৌজন্যে গিবস। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ওটা মনসুর আলি খান পতৌদির নেতৃত্ব দেওয়া প্রথম ম্যাচ ছিল।
ঘটনা একটু বিশদে বলা যাক, ১৯৬২ সালে বার্বাডোজে সিরিজের তৃতীয় টেস্ট। মুখোমুখি ভারত এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রথম ইনিংসে ভারত করেছিল সাকুল্যে ২৫৮ রান। টপ স্কোরার ২১ বছরের অধিনায়ক নবাব মনসুর আলি খান পতৌদি ওরফে ‘টাইগার’। করেছিলেন ৪৮ রান। শেষে নেমে ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে একমাত্র ‘আফগান’ বংশোদ্ভূত টেস্ট ক্রিকেটার সেলিম দুররানীও করেছিলেন ৪৮। জয়সিমা করেছিলেন ৪১ রান। ব্যাস, স্যার ওয়েস হল, স্যার ফ্র্যাঙ্ক ওরেলরা মুড়িয়ে দেন ভারতের ইনিংসকে। জবাবে কোনও ব্যক্তিগত সেঞ্চুরি ছাড়াই ৪৭৫ রানের ‘পর্বত’ খাড়া করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সর্বোচ্চ ৯৬ রান করেছিলেন থার্ড ডাউনে নামা জো সলোমন। ৭ নম্বরে নেমে ‘দ্বিতীয়’ সর্বোচ্চ ৭৭ রান করেছিলেন অধিনায়ক ফ্রাঙ্ক ওরেল। ওপেনার কনরাড হান্ট করেছিলেন ৫৯। ভারত প্রথম ইনিংসে পিছিয়ে২১৭ রানে।
দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে চতুর্থ দিনের শেষে ভারতের রান ১২০ ওভারে ২ উইকেটে ১০৪ রান। রানের চেয়ে ওভার বেশি। সৌজন্যে গিবস এবং ভারতের টেস্ট সার্ভাইভাল মনোবৃত্তি। যদিও উইকেটের খাতায় তখনও তিনি নাম লেখাননি। শেষ দিনে ইনিংস হার বাঁচাতে ভারতের তখনও দরকার ১১৩ রান। ক্যারিবিয়ানদের দরকার ৮ উইকেট। শেষ দিনেই শুরু হল গিবসের 'যত কান্ড বার্বাডোজ'-এর ঘটনা।
প্রথম সেশন ক্রিজে জমে গেলেন বিজয় মাঞ্জরেকার এবং দিলীপ সারদেশাই। পুরো সেশন একটাও উইকেট পায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ম্যাচ ড্রয়ের পথে। লাঞ্চে ভারত ১৫৪ ওভারে ১৫৮/২। গিবস ভারতের ইনিংসে কাঁপ ধরানো শুরু করলেন সেকন্ড সেশনের শুরু থেকেই। টার্ন এবং বাউন্স পেতেই নাচন শুরু হল তাঁর। লেন্থে পড়ে একেকটা বল যেন সাপের মত টার্ন করছিল। একে একে শিকার দিলীপ সারদেশাই (৬০), বিজয় মাঞ্জরেকার (৫১)। ক্রিজে এলেন অধিনায়ক টাইগার পতৌদি। আউট ২ বল খেলেই। গিবসের স্কোয়ার টার্ন করা বল, ক্যাচ গেল ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগের হাতে। ১৫৮/২ থেকে মুহূর্তের ভারত ১৫৯/৫! ‘গিবস ঘূর্ণি’ সামলাতেই পারল না সেরা স্পিন খেলিয়ে ব্যাটসম্যানরা।
'আয়া রাম গয়া রাম' হয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে যান পলি উমরিগড়, চান্দু বোর্দে, ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার, সেলিম দুররানী, রমাকান্ত দেশাইরা। ভারতের ১৮৫.৩ ওভারের প্রতিরোধ সেদিন থেমে গিয়েছিল ল্যান্স গিবসের ১৫ ওভারের একটা লং স্পেলেই। যার ১৪ আবার মেডেন। ওই স্পেলে তিনি ৬ রান দিয়ে ৮ উইকেট নেন। ইনিংসে গিবসের বোলিং ফিগার, ৫৩.৩ ওভারে ৩৭ মেডেন ৩৮ রান দিয়ে আটটা উইকেট।
এটা ছিল শুরুর দিকের গিবস। যত সময় গিয়েছে তত ভয়ংকর হয়েছেন তিনি, তাও আগুনে পেস জমানায়। ল্যান্স গিবস ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সেরা স্পিন বোলার। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসেও সেরা স্পিনারদের অন্যতম। কারণ সেই সময়ে পিচ থেকে টার্ন পাওয়া যেত না আর ওয়েস্ট ইন্ডিজে আজকের মতো স্লো ট্র্যাক হতো না। আধিপত্য থাকত পেসারদের। এমন সময়ে ৭৯ ম্যাচে শিকার ৩০৯ টি উইকেট। তিনিই বিশ্বের প্রথম স্পিনার যিনি টেস্ট ক্রিকেটে ৩০০ উইকেট নেন। আরও ঘটনা হল লম্বা কেরিয়ারে একটাও নো বল করেননি, ইকনমি শুনলে চমকে যাবেন, ১.৯৮। হ্যাঁ, এটাই গিবস।