মনের মানুষ, লালন সাঁইজির শেষ দিন

মনের মানুষ, মানব রতন ফকির লালন সাঁই। লালন ফকির ছিলেন কবি, বাউল এবং দার্শনিক। কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন অন্য এক পৃথিবী। লালনের আখড়ায় মানব ধর্ম খেলা করত। আখড়া হয়ে উঠেছিল লালন ধাম, আবার কারও কারও কাছে সেটাই ছিল লালনের মাজার। ছেউড়িয়া আজও দুই বাংলার আউল, বাউল, ফকিরদের অন্যতম তীর্থস্থান। ধর্মীয়, রাজনৈতিক মাতব্বরদের নিদান উপেক্ষা করে একতারা হাতে ফকিররা অবলীলায় পৌঁছে যেতেন ছেউড়িয়ায়। আজও দিন বদলায় নিই।  
 
ছেউড়িয়ায় মাটির নীচে লালন শায়িত। লালন হিন্দুর নয়, মুসলিমের নয়, বৌদ্ধের নয়, লালন মানুষের। তাঁর দুটো ধর্মতত্ত্বের গান, আজকের জন্য যথার্থ; কারণ আজকের ভোর রাতের চেয়েও শক্তিশালী দীর্ঘ আঁধারে ডুবে আছে।
 
সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।
লালন বলে জাতের কি রূপ
দেখলাম না এই নজরে।
 
কেউ মালায় কেউ তসবি গলায়,
তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়।
যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়,
জাতের চিহ্ন রয় কার রে।
 
আর; 
জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি
সব দেখি তা না না না।
 
গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়
তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়
লালন বলে জাত কারে কয়
এই ভ্রমও তো গেল না।
 
ফকির লালন শাহের হাত ধরেই বাউলের বিশ্বায়ন। তাঁর ধর্ম তাঁকে জায়গা দেয়নি, মুসলমানের হাতে অন্ন খাওয়ার অপরাধে। বাড়ি ছাড়া লালন নতুন করে গৃহ ত্যাগী হয়েছিলেন। তবে ততদিনে সিরাজ সাঁইয়ের শিষ্যত্ব গ্রহণ করা হয়ে গিয়েছিল বলেও রক্ষা। সুফিধর্মের রীতি-প্রকরণ তিনি গ্রহণ করেছিলেন। সহজিয়াদের দেহকেন্দ্রিক সাধনা, সনাতন ধর্মের বিশ্বাস, ত্যাগ ও ঔদার্যের মেলবন্ধনে ধর্মের বেড়াজাল পেরিয়ে লালন মানব বন্ধনের এক লোকধর্ম তৈরি করেছিলেন। লোকায়তিক সংস্কার করে ডেকে এনেছিলেন নবজাগরণ। সমাজের প্রান্তিক, অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ নিশ্চিন্তে জিরিয়ে নিত তাঁর আরশি নগরে।
 
সুর আর কথার সারল্য বড় বড় তত্ত্বকেও তুচ্ছ করে দিতে পারব। কবি লালনের শিষ্যদের মধ্যে পাঞ্জু শাহ, ভোলাই শাহ, মলম শাহ, শীতল শাহ, মনিরুদ্দিন, গগন হরকরা, শিষ্য তথা বন্ধু কাঙাল হরিনাথ, সবাই মিলে গড়ে ছিলেন এক অন্য পৃথিবী। সেই আখড়াতেই লালনের জীবন শেষ হয়েছিল।
 
​জীবনের শেষ পর্যায়ে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন সাঁই, রোগশয্যায় শেষের দিনগুলোতে দুধ ছাড়া কিছুই খেতেন না। তবে মাছ খেতে চাইতেন। শেষের সময় যে আগত, সাধন সঙ্গিনী ও ধর্মকন্যা পিয়ারী তা বেশ বুঝতে পেরেছিলেন। তাই সাঁইজিকে কাছ ছাড়া করতেন না। লালন কিন্তু তাঁদের বুঝতে দিতেন না, কষ্টের কথা।
 শিষ্যদের বলছিলেন,
''ইন্তেকাল হলে হিন্দু মতে দাহ হবে না। আবার ইসলামি মতে জানাজা নামাজও পড়া যাবে না।''
 
দিনটা ছিল পয়লা কার্তিক...
সাঁইজির চলে যাওয়ার দিন, শিষ্যরা নাম-গান করেছে - 'পার কর হে দয়াল চাঁদ আমারে।
ক্ষম হে অপরাধ আমার ভবকারাগারে।
শেষের দিন সাঁইজিও সারা রাত গান করেছেন... 'পাখি কখন যেন উড়ে যায়।
বদ হাওয়া লেগে খাঁচায়।'
 
সেই কার্তিকের ভোরকে কলমে বেঁধে গিয়েছেন বসন্তকুমার পাল। তিনি লিখছেন, ''স্বরলহরী থামিয়া গেল, সমস্ত গৃহতল নীরব নিস্তব্ধ, ইহার পর শিষ্যগণকে সম্বোধন করিয়া 'আমি চলিলাম' বলিয়া তাঁহার কণ্ঠ হইতে শেষ স্বর উচ্চারিত হইল, নেত্রদ্বয় নিমীলিত করিলেন, সমাজ পরিত্যক্ত দীন ফকিরের জীবননাট্যের যবনিকাপাত হইল।'' আজ পয়লা কার্তিক নয়। ১৭ই অক্টোবর। ইংরেজি মতে আজ সাঁইজির ফেরার দিন। তারপর থেকে আরশীনগর আজও শূন্য হয়ে অপেক্ষা করছে সাঁইজির সুর ও স্বর শুনবে বলে। অপার বিশ্বে অনুরণনে বাজছে তাঁর পদ।​

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...