কলকাতার ইতিহাসের সাক্ষী লাল মন্দির

আজ এক বিখ্যাত মন্দিরের গল্প বলি, কলকাতার বিখ্যাত বনেদি বাড়ির বিখ্যাত মন্দির। কলকাতা প্রতিটি প্রান্তে ইতিহাস। শোভাবাজার চত্বরে চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউয়ে শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনের সামনেই মন্দিরটি লাল রঙের এই মন্দিরটিকে সকলে 'লাল মন্দির' বলেই ডাকেন। আজও এই মন্দিরে নিত্য সেবা চলে মহাড়ম্বরে। শোভাবাজার মেট্রোর কাছেই রাস্তার মাঝখানে লাল রঙের এই কালী মন্দির বহু প্রাচীন। এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময়, পথ চলতি সকলেই প্রণাম সারেন।
 
মন্দিরের দুই পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গিয়েছে। এই মন্দিরটি যখন তৈরি হয়েছিল, তখন রাস্তা ছিল না। তখন যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউ বা গিরিশ অ্যাভিনিউ তৈরি হয়নি। গনেশ চন্দ্র অ্যাভিনিউ ক্রসিং থেকে ভূপেন বোস অ্যাভিনিউ ক্রসিং পর্যন্ত সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ নামকরণের আগে এই রাস্তার নাম ছিল মহারাজা স্যার নরেন্দ্র কৃষ্ণ দেব স্ট্রিট। বর্তমানে সেন্ট্রাল এভিনিউ রাস্তা দুভাগে ভাগ হয়ে নাম হয়েছে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ ও যতীন্দ্র মোহন অ্যাভিনিউ। লাল মন্দিরটি যতীন্দ্র মোহন অ্যাভিনিউয়ের উপর অবস্থিত। মন্দির পরিচালনার জন্য একটি ট্রাস্টিও রয়েছে।
 
 
LalMandir1
 
 
নগর কলকাতার সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে এই মন্দিরের ইতিহাস; অন্তত ২৫০ বছর আগে এখানে ছিল একটি মাটির ঘর। সেখানেই তন্ত্র সাধনা করতেন অমরকৃষ্ণ। ক্রমশই মন্দিরে জনসমাগম হতে শুরু হয়। অমরকৃষ্ণ ঠাকুর শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেবের বাড়িতে চণ্ডীপাঠ করতেন। তবে অনেকেই বলেন শোভাবাজার রাজবাড়ির মেয়েদের শক্তিআরাধনার জন্য এই মন্দির তৈরি হয়েছিল। এ কথার সত্যতা পাওয়া যায়, কারণ বাজবাড়ির আরাধ্য দেবতা কৃষ্ণ, সেই জন্য শাক্ত পুজোর জন্য মন্দির তৈরি হল বাড়ির বাইরে। জনশ্রুতি রয়েছে, এই মন্দির থেকেই নাকি সুড়ঙ্গপথে রাজবাড়ির অন্দরমহলে চলে যাওয়া যেত। এই মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রঘু ডাকাতের কাহিনিও। সেই দুর্ধর্ষ ডাকাত নাকি একসময় রাজবাড়ির সমস্ত সম্পত্তির সঙ্গে যোগমায়ার মূর্তিটিও লুঠ করে নিয়ে যান। তারপর একটি পুকুরে ফেলে দেন। রাজা নবকৃষ্ণ দেব স্বপ্নাদেশ পেয়ে আবার প্রতিমা তুলে এনে প্রতিষ্ঠা করেন।
 
কেউ বলেন মন্দিরটি রাজা নবকৃষ্ণ দেব তৈরি করেছিলেন, আবার একদল ঐতিহাসিক বলেন ছোটোরাজা কালীকৃষ্ণ মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন। মন্দিরটি তৈরির ‌এক গল্প শোনা যায়, একদিন মধ্যরাতে কার্তিক নামের একজন লোক কালী প্রতিমা এনে রাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের রাজবাড়ির সামনে পুজো করা শুরু করেন। রাজবাড়ির সামনে এই কালী পুজো কৃষ্ণভক্ত রাজা মেনে নিতে পারেননি, তাই একদিন রাতে তাঁর দাড়োয়ানকে বলেন ওই পূজারী এবং তার সাথে তার কালী প্রতিমাকে দূরে সরিয়ে দিতে।
 
সেইদিন রাতে মা কালী রাজাকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে আদেশ করেন ওই পূজারী কার্তিক এবং তার প্রতিমাকে ওখানে ফিরিয়ে আনতে ও একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে। তাই প্রথম দিকে এই মন্দিরটিকে স্থানীয় লোকেরা "ফেলা কার্তিকের মন্দির" নামে ডাকত, কিন্তু পরবর্তীকালে এটি "লাল মন্দির" নামে পরিচিত হয়েছে। এক সময় নাকি মাটির নিচ দিয়ে রাজবাড়ী থেকে এই কালী মন্দির অবধি রাজবাড়ীর মেয়েদের জন্য সুড়ঙ্গ পথ ছিল। এটি পুটিয়া কালী মন্দির। প্রায় ২০০ বছর আগে যোগী অমরকৃষ্ণ চক্রবর্তী স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর শোভাবাজার রাজবাড়ীর পুকুর থেকে একটি ১০ ইঞ্চি কালী মূর্তি কুড়িয়ে পান। যোগমায়া রূপে এখানে পুটিয়া কালী পুজো হয়। শোল মাছ দিয়ে ভোগ দেওয়াই এখানকার রেওয়াজ।
 
 
LalMandir2
 
এই মন্দিরকে ঘিরে আছে আরও নানা কাহিনি। রাস্তার ঠিক মাঝে এত বড় একটা মন্দিরের অবস্থান সত্যিই অবাক করে। ব্রিটিশ প্রশাসকরা রাস্তা তৈরির সময়েও সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। হোক রাজার মন্দির, কিন্তু রাস্তা তৈরির কাজ সবার আগে। তবে মন্দির ভাঙা হল না। শোনা যায়, অনেক মজুর নাকি তখন মন্দির ভাঙতে গিয়ে মুখে রক্ত উঠে মারা যায়। কথিত আছে, যখন রাস্তা তৈরি হচ্ছিল, মন্দিরটা ভাঙার চেষ্টা হয়েছিল।
 
কিন্তু সেই সময় রাস্তা তৈরির কাজে কর্মরত কিছু লোকের মৃত্যু হয়। বাকিরা তখন আর মন্দির ভাঙতে রাজি হয়নি। এও শোনা যায়, ইংরেজরা রাস্তা তৈরি করার সময়ে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মন্দিরটি অক্ষত রেখেই রাস্তা তৈরি করে। আবার কেউ কেউ বলেন যখন রাস্তা তৈরি হয় যে ইঞ্জিনিয়ার এটি ভাঙার চেষ্টা করেন তিনি মারা যান। এরপর থেকে যারাই চেষ্টা করতে ‌যার তারাই মারা যান। এইভাবে ৩ জন ইঞ্জিনিয়ার মারা যায়। এরপর আরও নানা সময় রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য মন্দির ভাঙার প্রস্তাব ওঠে। কিন্তু প্রতিবারই প্রস্তাব বাতিল হয়।
 
তখন কর্পোরেশন থেকে ঠিক করা হয়, মন্দিরটি রেখে দেওয়া হবে। ​এমন কি! মেট্রো রেলের খনন কার্যের সময়ও এই মন্দিরের গায়ে কোন আঁচড় পড়েনি। মন্দির অক্ষত রেখে মেট্রোর খননের জন্য ৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। আজও সেই মন্দিরের মধ্যে যোগমায়ার পাশাপাশি পূজিত হচ্ছেন গোপাল, শিব, অন্নপূর্ণাসহ আরও নানা দেবদেবী। এক অদ্ভুত সহাবস্থান। এই মন্দিরের এক বিশেষত্ব আছে তা হল, এখানে বিষ্ণুর দশম অবতার কল্কি দেবতার পুজো হয়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...