সারা শহর যখন উৎসবে মাতোয়ারা, ঠিক সেই সময় মধ্য কলকাতার এই অঞ্চল জাগে আরও সজাগ ভাবে। অপরাধ জগতের ত্রাস কলকাতার এই অঞ্চল। এলাকাটির নাম, লালবাজার। শহরের গোয়েন্দাপীঠ হিসাবে পরিচিত হলেও জায়গাটি সঙ্গীতপ্রেমী ও ঘড়িবিলাসী মানুষের পীঠস্থান বললেও অত্যুক্তি হবে না। একদিকে শহরের নিয়ম-শৃঙ্খলা অন্যদিকে বা্দ্যযন্ত্রের সুর আবার ঘড়ির কাঁটার টিকটিক আর আসবাব তৈরির খুটখাট নিয়েই সরগরম কলকাতার গর্ব লালবাজার।
তবে প্রশ্ন হল, কলকাতার সাবেকি অফিসপাড়া ডালহৌসির স্কোয়ারের কাছাকাছি এই অঞ্চলের নাম লালবাজার কেন? এই নামকরণের কারণ নিয়ে মতপার্থক্য আছে। একটি মত অনুযায়ী, ডালহৌসি স্কোয়ারের কাছে সে যুগে পুরোনো কেল্লা অর্থাৎ Old Fort William এর রং ছিল গাঢ় লাল। সেই লাল বাড়ির প্রতিবিম্ব পাশের জলাশয়ে পড়ার ফলে সেটার নাম হয় লালদীঘি। আর সংলগ্ন অঞ্চলের নাম হয় লালবাজার।
আরেকটি মত বলে, পুরোনো কেল্লা নয়, ওই এলাকায় অবস্থিত ওল্ড মিশন চার্চের রক্তিম প্রতিবিম্ব দীঘির জলে পড়ায় দীঘির নাম হয় লালদীঘি ও জায়গাটির নাম লালবাজার।
তবে, এই বিষয়ে তৃতীয় মতটিও বেশ মজাদার। তৃতীয় মত বলে, কলকাতার তৎকালীন অভিজাত রায়চৌধুরী পরিবার অর্থাৎ বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরী দের কাছারি বাড়ি ছিল এই ডালহৌসি(অধুনা বি.বা.দী বাগ)অঞ্চলে। এছাড়াও ছিল তাঁদের পারিবারিক শ্যামরায়ের মন্দির। প্রতিবছর দোলের সময়, সেই মন্দিরে এত বেশী রং আর আবির খেলা হত যে দোল খেলার পর সবাই যখন দীঘির জলে স্নান করতে নামতেন তখন দীঘির জল লাল হয়ে যেত। ফলে, দোলের সেই লাল রং থেকে যথাক্রমে লালদীঘি ও লালবাজার।
লালবাজারের ইতিহাস নাড়াচাড়া করলে মুখোমুখি হতে হয় একের পর এক বিস্ময়ের। সেসময় কলকাতায় জন সাধারণের জন্য তেমন কোনও বিশ্রামাগার ছিল না, শুধু লালবাজার স্ট্রিটেই ছিল হার্মনিক্ ট্যাভার্ণ ও হোটেল লন্ডন। পুরোনো নথিপত্র থেকে জানা যায় এই লালবাজার স্ট্রিট অতীতে Great Bunglow Road নামেও পরিচিত ছিল। মনোরম পরিবেশের জন্য একসময় ব্রিটিশদের কাছে এই রাস্তা পরিচিত ছিল "The best Street in Calcutta" নামে। তবে নাম যাই হোক, গুরুত্বে লালবাজার স্ট্রিট আজও সকলের কাছে পরিচিত নামের এক পথ।
লালবাজারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঠিকানা ১৮ লালবাজার স্ট্রিট। বলা বাহুল্য, এই ঠিকানার লাল বাড়িটি কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তর- অন্ধকার জগতের ত্রাস। কিন্তু এই বাড়িটা আসলে ছিল Merchant Prince জন পামারের বাসভবন। এই জন পামারের বাবা ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের সচিব। ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দের অক্টোবর মাসের শেষ দিকে সরকার বাড়িটি কিনে নেন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার ও পরিবর্দ্ধন করেন। এই বাড়িটিই পরবর্তী কালে হয়ে ওঠে কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তর।
লালবাজারের আরও একটি আকর্ষণ বাদ্যযন্ত্রের বাজার। দেশী-বিদেশী প্রায় সবরকম বাজনার এত বিপুল সম্ভার ভারতের আর কোনো জায়গায় বোধহয় নেই। তাই কলকাতা বা দূরের সদ্য শিক্ষানবিশ থেকে প্রতিষ্ঠিত শিল্পী বা সুরের শিক্ষক-শিক্ষিকা সকলেরই পছন্দের স্হান এই অঞ্চল।
লালবাজার যদি সঙ্গীতপ্রেমীদের পছন্দের জায়গা হয়, তাহলে তার ঠিক পাশেই রাধাবাজার কে বলতে হবে ঘড়িবিলাসী মানুষের প্রিয় পীঠস্থান। তবে শুধু বিলাসীদের জন্যই নয়, ঘড়ির কাঁটা কে এড়িয়ে কেই বা চলতে পারে? তাই বলা যায় প্রায় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য এই ঘড়ির বিপুল সম্ভার এই রাধাবাজার, যেখানে দেওয়াল ঘড়ি থেকে হাতঘড়ি সব কিছুই মেলে সামর্থ্য মিলিয়ে।
ইতিহাস, নিয়মানুবর্তিতা, সুরের মূর্ছনা সব মিলিয়ে লালবাজারের ছন্দ যেন বেঁধে রাখে কলকাতাকে, হুজুগে কলকাতাবাসীকে। তাই গোটা শহর যখন ভাসে উৎসবের জোয়ারে লালবাজার তখন জাগে শহরবাসীকে নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা দিতে, আবার মহামারীর ভয়ে গোটা দেশ যখন কার্যত গৃহবন্দী, তখনও এই পাড়ার লালবাড়িটা বাড়িয়ে দিয়েছে বন্ধুত্বের হাত। তাই বলা যায়, লালবাজার আসলে কোনো অফিসপাড়া বা ব্যবসা বাণিজ্যের বাজার না, এই জায়গা শহরবাসীর নিশ্চিন্ত নিরাপত্তার আশ্রয়।
নিবন্ধকারঃ প্রদীপ্তা কুন্ডু