কালীকথা: করুণাময়ী মায়ের লেক কালীবাড়ি

কালীক্ষেত্র কলকাতা, কালী কলকাত্তাওয়ালী, ইতিহাস বলে কালী নাম থেকেই কলকাতা নামের জন্ম। এককালে কালীঘাটের জন্যই পরিচিত ছিল সাবেক কলকাতা। কালীঘাটের মন্দিরেই কলকাতার আদি পরচিয়। আর পূর্ণদাস রোডে রঘু ডাকাতের মন্দির তো ইতিহাসের একটা বিশেষ অধ্যায়। করুণাময়ী কালীমন্দির কিংবা লেক কালীমন্দির, এগুলোও কলকাতার সাম্প্রতিক ইতিহাসের অঙ্গ। কালীপুজোর রাতে তাই জমজমাট আদিগঙ্গার পাড়ের দক্ষিণ কলকাতা। তেমনই কলকাতার অন্যতম এক বিখ্যাত কালী মন্দির হল লেক কালীবাড়ি। বয়সে খুব একটা প্রাচীন নয়। কালীঘাট, দক্ষিনেশ্বরের কাছে শিশু বলা চলে। গত শতকের মাঝামাঝি স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। স্বপ্নে মন্দির প্রতিষ্ঠা করার আদেশ পেয়েছিলেন জনৈক হরিপদ চক্রবর্তী। হরিপদ ছিলেন ধর্ম প্রাণ ভক্ত মানুষ, কিন্তু সে সাধারণ মানুষ, গরিব মানুষ মন্দির গড়ার এত টাকা পাবেন কোথা থেকে? কিন্তু ভক্তকে আশ্বাস দেন দেবী স্বয়ং। বলেন, নিজের পুজোর ভার তিনি নিজেই নেবেন। সেই মতো এক পর্ণকুটিরে গড়া হয় মন্দির, সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে আজকের লেক কালীবাড়ি। ভক্তদের সাহায্যেই চলে মন্দির। কলকাতার ব্যস্ত রাস্তার ধারের এই মন্দিরে রোজই বিপুল ভক্ত সমাগম। তবে কার্তিক মাসের অমাবস্যায় অর্থাৎ কালীপুজোর দিন ভিড়টা অনেক বেশি। পুজোর সময় এই মন্দিরে দেবী সাজ বদলায়। কখনও ফুলের, কখনও এবার সোনার সাজে সালাঙ্কারা মাতৃমুর্তি।

lake

১৯৪৯ সালে তন্ত্রসাধক হরিপদ চক্রবর্তী এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মন্দিরটি লেক কালীবাড়ি হিসেবে পরিচিত হলেও মন্দিরটির আরেক নাম শ্রীশ্রী ১০৮ করুণাময়ী কালীমায়ের মন্দির। প্রথম প্রথম মন্দিরটি শ্রীশ্রী ১০৮ করুণাময়ী কালীমায়ের মন্দির নামেই পরিচিত ছিল। দক্ষিণ কলিকাতার রবীন্দ্র সরোবর অর্থাৎ ঢাকুরিয়া লেকের ধারে মন্দিরটি অবস্থিত হওয়ায় লেকের পাশ্ববর্তী সার্দান অ্যাভিনিউের এই মন্দিরটি লোক মুখে লেক কালীবাড়ি হিসেবে পরিচিতি পায়। মন্দিরের প্রতিষ্ঠিত কালীমূর্তিটির নাম করুণাময়ী কালী।

মন্দিরটির বয়স বেশী দিন নয়। এই কালীবাড়ি ঘিরে নানান কাহিনী ও গল্প শোনা যায়। মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মা কালীর ভক্ত তন্ত্রসাধক হরিপদ চক্রবর্তী। দিনের অধিকাংশ সময় তিনি মায়ের সাধনা করতেন। সাধারন মানুষের কাছে তিনি ছিলেন গুরুদেব। পরবর্তী সময়ে তাঁর সাধনায় খুশী হয়ে মা কালী তাঁকে দর্শন দিয়েছিলেন। তন্ত্রসাধনার উদ্দেশ্যে হরিপদ চক্রবর্তী পাঁচটি নরমুণ্ড দিয়ে একটি 'পঞ্চমুণ্ডির আসন' তৈরি করেন। এখনও কালীমূর্তির পাশে এই পঞ্চমুণ্ডির আসন রাখা রয়েছে। মন্দিরের পাশের ঘরে হরিপদ চক্রবর্তীর মূর্তি রয়েছে। হরিপদ চক্রবর্তী নিজে একজন তান্ত্রিক ছিলেন। মাতৃসাধক হরিপদ চক্রবর্তীর কারণেই কালীমন্দিরের মহাত্ম ক্রমে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে মন্দিরটি কলকাতা শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কালী আরাধনার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।

প্রতিদিন নিত্যপুজো হয়। সপ্তাহের মঙ্গল ও শনিবারও বিপুল ভক্ত সমাগম হয়। ভক্তদের জন্য প্রতি মঙ্গলবার এবং শনিবার মন্দিরে ১৫ মিনিট অন্তর অন্তর অঞ্জলি দেওয়ার সুবন্দোবস্ত রয়েছে।  পুজোর সময় এখানে সাজ বদল দেবীর। বর্তমানে এখানে করুনাময়ী কালীমাতা ট্রাস্ট নামক একটি ট্রাস্ট বোর্ড রয়েছে, যারা এই কালীবাড়িটি পরিচালিত করেন। লেক কালিবাড়ির উল্টোদিকের সুজ্জিত পার্কে হরিপদ চক্রবর্তীর মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে।

মন্দিরের ভিতরে মা বগলার মূর্তি রয়েছে। দক্ষিণ কলকাতার বিখ্যাত এই লেক কালীবাড়িতে দক্ষিণা কালীর পুজো হয়। মন্দিরে দেবী বগলা ও সন্তোষী মায়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০২০ সালের ২৩শে জানয়ারি এই মন্দিরে দশ-মহাবিদ্যার সপ্তম বিদ্যা দেবী ধূমাবতির মূর্তির প্রতিষ্ঠতা হয়েছে। আগামীতে মা শীতলা ও মা মনসা দেবীর মূর্তিও প্রতিষ্ঠা করার কথাও রয়েছে।

লেক কালীবাড়ির সঙ্গে লেক ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছে, কালীবাড়ির রীতি মেনে পুজো শেষে ঘটের বিসর্জন হয় লেকে এবং তারপর লেক থেকেই জল তুলে রাতে আবার মা কালীর পুজো শুরু হবে। কালী পুজোর দিন সারা রাত ধরে পুজো চলে, অঞ্জলি হয় একদম পুজোর শেষে। অর্থাৎ, অঞ্জলি হতে হতে ভোর হয়ে যায়। লেক কালীবাড়ি প্রথা অনুযায়ী প্রত্যেকবারই কালীপুজোর দিন মাকে আমিষ ভোগ নিবেদন করা হয়। ভোগের তালিকায় থাকে একাধিক রকমের মাছ, খাসির মাংস, পাঁচ রকমের ভাজা, পোলাও, পাঁচমিশালি তরকারি, পায়েস। পুজোর রাতে মা কালীকে এই ভোগ নিবেদন করা হয়। কালী পুজোর দিনে এখানে বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয়। প্রতি বছর ১৩ ই এপ্রিল এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা দিবস পালিত হয়। ১০ই ফেব্রুয়ারি গুরুদেব শ্রী শ্রী হরিপদ চক্রবর্তীর জন্মদিনও পালিত হয় মন্দিরে। বর্তমানে মন্দিরটি দেখাশোনা করেন নেতাই চন্দ্র বসু।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...