যুগ যুগ ধরে আমরা দেখে আসছি, পুরুষেরা বাইরে কাজ করে এবং নারীরা ঘর সামলায়। বিভিন্ন সামাজিক পটভূমিকায় এই রকমই হয়ে আসছে। পর্দানশীন নারীরাই সমাজে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ভারতীয় সমাজের একেবারে শুরুর দিকে কিন্তু এরকমটা ছিলনা। আমরা গার্গী, অপালা, লোপামুদ্রা, মৈত্রেয়ী প্রভৃতির নামের সঙ্গে তেমনভাবে পরিচিত না হলেও ইতিহাসের পড়ুয়ারা এনাদের নামের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত। বৈদিক যুগে এঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছেন এঁরা। তাছাড়াও মহাভারতের অর্জুনের অন্যতম ঘরণী চিত্রাঙ্গদার নাম কে না জানে? মনিপুরের এই রমণী যেমন নৃত্যে পটিয়সী ছিলেন, তেমনি যুদ্ধবিদ্যায় ছিলেন পারদর্শী। কিন্তু ধীরে ধীরে দিন পাল্টেছে, যুগ পাল্টেছে। সমাজ পরিবর্তিত হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে। পুরুষরা তাদের প্রভাব সমাজে কায়েম রাখতে নারীদের পর্দার আড়ালে রাখতেই সিদ্ধহস্ত হয়েছে। যে সমস্ত নারীরা তার বিরুদ্ধাচরণ করেছে, তাদের কুলাঙ্গার বলে অভিহিত করা হয়েছে।
তাই সুশীল নারী হতে চেয়ে নারীরাও এই ব্যবস্থাকে নিজের করে নিয়েছে। এসেছে মুসলিম শাসন, আরও অভ্যন্তরে চলে গেছে নারীদের জীবন। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন ভারতে প্রবর্তিত হওয়ার পর একটু একটু করে সমাজের পরিবর্তন ঘটতে শুরু করল। ইংরেজরা কলোনিয়াল শাসন প্রবর্তন করলেও ভারতের কিছু কিছু বিদগ্ধজনেরা ইংরেজদের শিক্ষানীতিকে সম্বল করে ভারতে নারীদের অবস্থার উন্নতিকল্পে এগিয়ে এলেন। পরিবর্তন হতে শুরু করল ভারতীয় নারীর অন্দরমহল। পর্দানশীন থাকলেও শুরু হল শিক্ষার আলোকে আলোকিত হওয়ার সুযোগ। আস্তে আস্তে নারীরা সমাজের মূলস্রোতে আসার সুযোগ পেল। শুরু হল পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলা। কিন্তু কোথাও যেন নারীদের মজ্জায় ঢুকে পড়েছিল এতদিনের বয়ে চলা সামাজিক নিয়মগুলো। নারীরা ঘর সামলাবে এবং পুরুষেরা বাইরে। তার অন্যথা হলে এখনো যেন কোথাও গিয়ে সুতো ছেঁড়ার উপক্রম হয়। এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও প্রচুর পড়াশুনো শিখে নারীরা শুধুমাত্র সংসারের জন্য নিজেদের সমস্ত কেরিয়ার জলাঞ্জলি দিতে পিছপা হত না। মা-বাবার কাছে থাকার সময় যেভাবে বড় হয়েছে, শ্বশুরবাড়িতে এসে তার বিপরীতে চলার মত তৈরী করে নিত নিজেদের। নিজের অর্জিত শিক্ষা তাই অনেক সময়েই জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে নারীদের।
কিন্তু এখন বর্তমানে আরো দিন বদলেছে। আমরা এখন চারদিক দিয়ে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠছি। তাহলে কেন প্রাচ্যের ভাবধারাকে গ্রহণ করে নিজেদেরকে সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করবনা? কেন ছোট থেকে পাওয়া শিক্ষা কে নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করবনা? একবিংশ শতাব্দীতে এসে এই ভাবনা এবং চিরাচরিত ভাবনা- দুইয়ের দোলাচলে নারীরা মাঝে মাঝেই দিশাহীন হয়ে পড়ছেন। এর জন্য চাই সঠিক এবং দৃঢ় পদক্ষেপ।
তবে মেয়েদের মন প্রাকৃতিকভাবেই কোমল স্বভাবের। তারা সকলকে নিয়ে থাকতে ভালোবাসে। স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। স্বামী-সংসার নিয়ে থাকতে, তাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। আজকের মেয়েরা নিজেদের নিয়েও স্বপ্ন দেখে। তারা নিজেরা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখে। মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ অনুসারে স্বপ্ন কথাটার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে আমাদের অবচেতন মনের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা ইচ্ছা, চাহিদা, দ্বন্দ্ব, প্রভৃতির প্রকাশ। ঘুমের মধ্যে মনের গভীরতা ঠেলে এই চিন্তাগুলো ওপরে উঠে আসতে চায়। সাধারণ মানুষের কাছে স্বপ্ন কথাটার মানে একপ্রকার ইচ্ছে মিশ্রিত কল্পনা। যা মানুষ সচেতনভাবেই করতে ভালোবাসে। অবচেতন মনে স্বপ্ন দেখাটা নারী-পুরুষের ক্ষেত্রে একই প্রক্রিয়ায় ঘটে। কিছু চিহ্নের দ্বারা স্বপ্নগুলি আবর্ত থাকে, যা কেবল এক মনোবিশ্লেষক ছাড়া আর কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়। তাই এখন সেই স্বপ্নকে একটু ঘুরিয়ে দেখার দিন এসেছে। শুধুমাত্র ঘরকে নিয়ে স্বপ্ন না দেখে নারীরা যেন নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, তার সময় এসেছে এখন। এইভাবে স্বপ্ন দেখতে পারলে আখেরে সমাজেরই লাভ।