পঞ্জিকা বলছে ভাদ্র মাস চলছে, আশ্বিন আসন্ন। দরজায় কড়া নাড়ছে দুর্গা পুজো। এই পুজো আসছে শব্দটাই বাঙালিদের কাছে যথেষ্ট। শরৎ এলেই পুজো আসে। শিউলি ও কাশফুল আর সন্ধ্যে বেলার ছাতিমের গন্ধ জানান দেয় উমার আগমনীবার্তা। ত্রিনয়নী দুর্গা, মা তোর রূপের সীমা পাই না খুঁজে। মায়ের রূপের যেন সীমা নেই। শ্রীশ্রী চণ্ডীতে দেবী দুর্গার মাহাত্ম্য বর্ণনায় বলা হচ্ছে, ‘নিঃশেষ দেবগণশক্তি সমূহ মূর্ত্যাঃ’, অর্থাৎ সমস্ত দেবতাদের শক্তির সম্মিলিত প্রতিমূর্তিই হলেন দেবী দুর্গা। তাই দেবীর রূপও বিভিন্ন। দুর্গা পুজোয় দেবীর দশভুজা রূপটিই বেশি জনপ্রিয়, অন্ততঃ অকাল বোধন অর্থাৎ শারদীয়ার ক্ষেত্রে তাইই। আবার কোথাও তিনি দ্বিভুজা, কোথাও ত্রিভুজা, কোথাও চতুর্ভুজা, ষড়ভুজা, অষ্টভুজা আবার কোথাও সহস্রভুজা রূপেও বিরাজমানা। দেবী নানান নামেও পরিচিতা। মহিষাসুরকে বদ করে মহিষাসুরমর্দিনী, এছাড়াও শূলিনী, জয়দুর্গা, বনদুর্গা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী ইত্যাদি নানা নামে দেবী পূজিতা হন। এঁদের আকৃতিতেও রকমফের রয়েছে। বাংলায় প্রচলিত পৌরাণিক পদ্ধতি অনুসারে, দেবী দুর্গা অতসীপুষ্পবর্ণকা, দশভুজা, জটাজুট সমাযুক্তা। অর্ধচন্দ্র দেবীর শিরোভূষণ। দেবীর পাদদেশে ছিন্নমস্তক মহিষ বিদ্যমান। মহিষের দেহ থেকে খড়্গ হাতে যে দানব বেরিয়ে এসেছে, দেবী তাকে দেবীর ত্রিশূলে বিদ্ধ করেছেন। দেবী সিংহবাহিনী, দেবী ডান পা সিংহের পিঠে, আর বাঁ পায়ের আঙুল, একটু ওপরে মহিষের দেহ ছুঁয়েছে। অষ্টশক্তি ও দেবগণ ঘিরে আছেন দেবীকে। তাঁর দুপাশে ভরা সংসার। কার্তিক-গণেশ এবং লক্ষ্মী-সরস্বতী, এদের প্রত্যেকের বাহন বিদ্যমান। নবপত্রিকাও আসেন। আবার কোথাও জয়া-বিজয়ার মূর্তি দেখা যায়, কালীবিলাস তন্ত্রে যার বিধান রয়েছে।
তন্ত্রসার মতে, দেবী দুর্গা চতুর্ভুজা। প্রাচীন গ্রন্থ দেবী ভাগবত পুরাণ অনুসারে দেবীর বাহুসংখ্যা ১৮। কিংবদন্তি পুরাণ মতে ১৬, বরাহ পুরাণ মতে ২০, রামায়ণে দেবী চতুর্ভুজা। দুর্গাভক্তি তরঙ্গিনীতে আবার অষ্ট ও চতুর্ভুজা। বাংলার প্রায় সর্বত্রই দেবী ত্রিনয়নী এবং দশভুজা হলেও, কোথাও কোথাও আজও ব্যতিক্রমী মূর্তি চোখে পড়ে। কিন্তু আজ ব্যতিক্রমে রূপ আবহের কথা হবে। দেবী তো বরাভয় দাত্রীও বটে। তিনি বাড়ির মেয়ে হিসেবেই পূজিতা।
যেমন হাণ্ডে জমিদার পরিবার, তাদের একমাত্র কন্যার স্মরণে দুর্গা আধারণা করে। অকাল প্রয়াত কন্যাকেই তারা পুজো করে আসছেন কূল পুরোহিতের নির্দেশে। দুর্গাকে দুহিতা হিসাবে আজও পুজো করে বর্ধমানের অণ্ডাল থানার উখড়ার হাণ্ডে পরিবার। প্রয়াত কন্যার শোক ভুলতেই জমিদার বাড়িতে দুর্গার কন্যারূপে আগমন হয়। পুরোহিতের কথা মতো বলি প্রথাও বন্ধ করে দেয় হাণ্ডে পরিবারে। উখড়ার জমিদার ছিলেন শম্ভুলাল সিংহ হাণ্ডে। দুর্গাপুর-ফরিদপুর, অণ্ডাল ও কাঁকসাসহ একাধিক জায়গায় ছড়িয়ে ছিল তার জমিদারি। হঠাৎ করেই তার একমাত্র কন্যা অসুস্থ হয়ে, মারা যায়। এক মাত্র কন্যার অকাল প্রয়াণে জমিদার বাড়িসহ এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। গভীর শোকাহত জমিদার শম্ভুলাল সিংহকে কুল-পুরোহিত আদেশ দেন দুর্গাকে কন্যা হিসেবে পুজো করার। সেই মতো জমিদার পরিবারে দুর্গাপুজো হয়। প্রায় দুশো বছরের প্রাচীন এই পুজো। জমিদার শম্ভুলাল সিংহের ১২তম বংশধর বর্তমানে পুজোর আয়োজন করেন।
স্থানীয় চাঁদনি বাড়ির নাটমন্দিরে পুজো হয়। মহাড়ম্বরে এখনও একচালা দুর্গা প্রতিমায় পুজো হয়। দেবী দুর্গাকে হাণ্ডে বাড়ির মেয়ে হিসেবে ডাকা হয়। প্রাচীন ঐতিহ্য বজায় রেখেই মা দুর্গাকে ঘরের মেয়ে হিসেবেই পুজো করা হয়। মন্দিরের মধ্যেই একচালা প্রতিমা নির্মাণ করা হয়। বংশপরম্পরায় একই পরিবারের মৃৎশিল্পী প্রতিমা নির্মাণ করেন। দেবী দুর্গাকে ডাকের সাজে সাজানো হয়। দুর্গা এখানে মেয়ে হিসেবে পূজিত হন সেই কারণেই এখানে পুজোতে বলিদান প্রথার বালাই নেই। ফল, সব্জি, মিষ্টি বা পশুবলি কোনরকম বলিদান কিছুই হয় না। হাণ্ডেরা ক্ষত্রিয় হওয়ায় ব্রাহ্মণ পুরোহিত পুজো করেন। এদের পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট হল, দশমীর দিন হাণ্ডে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য দুর্গাকে আরতি করে সেবারের মতো বিদায় জানান। চারদিন নিষ্ঠার সহকারে পুজো অর্চনার পাশাপাশি খাওয়া-দাওয়া, ভোগ নিবেদন চলে।
আরেক পুজোর কথা বলব, হাওড়া জেলার সে পুজোতেও মা মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পূজিত হন না। হাওড়ার আন্দুল বাজার বাসস্টপের কাছ থেকে কিছুটা দূরেই কুণ্ডু চৌধুরীদের বিশাল জমিদার বাড়ি অবস্থিত। জায়গার নাম মহিয়ারী। কুণ্ডু চৌধুরীদের বাড়িতে বছরে দুবার দুর্গা পুজো হয়, বাংলার আরও কোথাও কোথাও হয় এমনটা। যাই হোক কুণ্ডু চৌধুরীদের বাড়িরর কথায় ফিরি। এখানে একবার দুর্গা পুজো হয় চৈত্র মাসে বাসন্তী পুজো। অন্যটি এই শরৎকালে শারদীয়া, অকাল বোধন অর্থাৎ দুর্গাপুজো।
এই বাড়ির পুজোর অন্যতম সেরা বৈশিষ্ট্য হল, এখানে দেবী মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পূজিতা হন না। দেবী যুদ্ধরত নন। তাই অসুর, মোষ, সিংহ কিছুই থাকে না এই বাড়ির দুর্গা প্রতিমায়। এখানে দেবীর পারিবারিক রূপ পূজিত হয়। দেবী পরিবারের একজন। পুত্র কন্যা স্বামীর সঙ্গে মিলে প্রতিমার সেই রূপের নাম হরগৌরীর। সেখানে ষাঁড়ের পিঠে বসে আছেন শিব, তাঁর পাশেই মা দুর্গার অত্যন্ত শান্ত রূপ। তাঁদের ঘিরে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, যেন হাসিখুশি এক পারিবারের ছবি। বাসন্তী পুজো ও শারদীয়া, দুটে ক্ষেত্রেই মায়ের একই মূর্তি। দুটো পুজোই কিন্তু একই কাঠামোর ওপরে হয়। উল্টোরথের দিন সেই কাঠামো পুজো হয়। এঁদের গৃহ দেবতা লক্ষ্মী জনার্দন, সারা বছর তাদের নিত্য পুজো হয়। সেই কারণে দেবী দুর্গার পুজোও বৈষ্ণব মতে মেনে হয়। পুজোর কয়েকদিন আমিষের খাবারের কোন বিষয় থাকে না। দশমীর দিন বিসর্জনের জন্যে মাকে ঠাকুরদালান থেকে উঠোনে নামানোর পরেই মাছ খাওয়া হয়।
পুজোর আরও একটি বৈশিষ্ট হল, এখানে হরগৌরীর সঙ্গে সঙ্গে গরুড়ের পুজোও হয়। দুর্গার পাশেই একটি রূপোর সিংহাসনে গরুড় অধিষ্ঠান করেন, পুজোর সামগ্রীও সব রূপোর। এমন সচরাচর দেখা যায় না। গরুড়ের পুজোও বেশ বিরল। পুরনো প্রথা মেনে, এখনও দুর্গা পুজোর সময়ে নৌকো পুজো করা হয়। অষ্টমী পুজোর দিন ধুনো পোড়ানোয় পরিবারের সব গৃহিণীরা অংশগ্রহণ করেন। এককালে প্রায় ৯৬ মন চালে নৈবেদ্য নিবেদন করা হত। আগে পাশেই বহমান সরস্বতী নদীতে বিসর্জন হত। তবে এখন তা মজে যাওয়ায়, দেবীর বিসর্জন হয় গঙ্গাতেই। মায়ের রূপ, পুজোর প্রকৃতি, পদ্ধতি যেমনই হোক না কেন, পুজো তো মা দুর্গার। বাঙালির বারো মাসের তেরো পার্বণের শ্রেষ্ঠ উৎসব।