কুমোরটুলি: দেবতার জন্মভূমি

সকালের শিশির, রোদ-বৃষ্টির লুকোচুরি, শিউলির সুগন্ধ, আর আগমনী গানের সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাশের দুলুনি আমাদের জানায় উমা আসছে। সমস্ত আসুরিক শক্তিকে শূলে বিদ্ধ করে সপরিবারে মা আসছে, আবার কারু কারু কাছে সে ঘরের আদরীনি কন্যা।

পুরাণ বলে, এই উমা গিরিরাজ হিমালয় ও মা মেনকার মেয়ে। তবে মর্ত্যের মাটির মেয়ে উমার বাপের বাড়ি তুষার শুভ্র হিমালয় নয়, তার বাপের কাদা, মাটি, বাঁশ, তুঁষে ভরা পোটো পাড়ায়। যেখানে পটুয়া বাপ-মা, ভাই, বোনের আদরে যত্নে তিল তিল গড়ে দুর্গা পায় তার রাজ রাজেশ্বরী রূপ। এইরকমই এক পটুয়া পাড়া কলকাতার কুমোরটুলি, যা আজ নিজগুণে হয়ে উঠেছে পৃথিবী বিখ্যাত।

বাঙালি যেখানে, দুর্গাপূজা সেখানে। আর দুর্গাপূজার হাত ধরেই সারা বিশ্ব চিনেছে কলকাতার কুমোরটুলিকে। কিন্তু কিভাবে গড়ে উঠল কলকাতার গর্ব এই কুমোরটুলি? সেই গল্প জানতে হলে, ফিরে যেতে হবে প্রায় তিনশো বছর আগের জলা-জঙ্গলে ঘেরা কলকাতা থুড়ি গোবিন্দপুর গ্রামে। দেবী দুর্গা তখন আসতেন শুধুমাত্র ধনী পরিবারের ঠাকুর দালানে। সেই অভিজাত বাড়ির মেয়েকে বাঁশ, খড়, মাটি আর রঙে গড়ে তুলতে কৃষ্ণনগর থেকে আসত পটুয়ারা। ধীরে ধীরে গঙ্গার ধারে শর হোগলার জঙ্গল কেটে তৈরি হল বসতি- কুমোর পাড়া। সেখানে দিন শুরু হত কুমোরের চাকার ঘর্ঘর শব্দে। সারাদিন ধরে তৈরি হত হাঁড়ি, কলসি ইত্যাদি মাটির বাসন। পাশে বটতলার হাটে চলত সেসব দ্রব্যের বেচাকেনা।

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দখল করে নেয় গোবিন্দপুর গ্রাম। শাসকের কলমের আঁচড়ে ঠাঁইনাড়া হতে হল এই গোবিন্দপুরের বাসিন্দাদের। পাথুরিয়াঘাটা আর জোড়াসাঁকোয় নতুন বসতি স্থাপন করলেন গোবিন্দপুরের ধনীরা আর মাটির সন্তানরা উঠে এল সুতানুটিতে। কোম্পানির আদেশানুসারে জন জেফানিয়া হলওয়েল কোম্পানির মজুরদের জন্য আলাদা আলাদা অঞ্চল বন্টন করেন। তৈরি হল পেশাভিত্তিক বসতি, যেমন, আহিরীটোলা, কলুটোলা, আর আমাদের আলোচ্য কুমোরটুলি প্রভৃতি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তুলনামূলক বড় জনবসতিকে বলা হয় টোলা আর তার থেকে ছোট হলে টুলি।

যাই হোক, নতুন যুগে নতুন হাওয়া লাগলো সমাজের পালে। মাটির বাসনের জায়গা দখল করতে লাগলো কাঁসা, পিতল প্রভৃতি ধাতব বাসন। তবে এই যুগে শুরু হলো নতুন এক প্রতিযোগিতা- অভিজাত পরিবার গুলোর মধ্যে পুজোর প্রতিযোগিতা। বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীর বাড়ি, শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেবের বাড়ি, জানবাজারে রাণী রাসমণির বাড়ি প্রভৃতি ধনী পরিবারের দুর্গাপূজায় ডাক পড়লো এই প্রতিমা বানিয়ে শিল্পীদের। উলুবেড়িয়া থেকে আসা মাটি, সালকিয়া থেকে আসা বাঁশ, গরানহাটা থেকে আসা গরানসুন্দরী কাঠ, দড়ি, খড় এই অল্প কিছু উপকরণ দিয়েই তৈরি হলো একান্নবর্তী পরিবারের মত একচালার দুর্গা।

ক্রমশ সমাজে এলো আরও বদল, অভিজাত বাড়ির ঠাকুর দালানের সীমা ছাড়িয়ে দুর্গা এসে দাঁড়ালেন সাধারণ মানুষের তৈরি বাঁশ কাঠের প্যান্ডেলে, হলেন সর্বজনীন। আরও বায়না এলো শিল্পীর ঘরে, তৈরি হতে থাকলো আরও মৃন্ময়ী দুর্গা। ক্রমে ক্রমে তৈরি হলো একচালা থেকে তিনচালা, পাঁচচালার ঠাকুর। দুর্গা যেন হলেন একাকী সেই মা যিনি অপেক্ষা করেন যার যার নিজস্ব বৃত্ত তৈরি হয়ে যাওয়া সন্তানদের জন্য। আলাদা আলাদা চালচিত্র যেন একেকটি আলাদা সংসার, পুজো উপলক্ষ্যে লক্ষী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশও যেন নিজস্ব বৃত্ত নিয়েই আসে মায়ের কাছে, মায়ের পাশে।

তবে শুধু দুর্গা নয়, আরও অনেক দেবদেবীর অভিভাবক এই মাটির শিল্পীরা। বাবাদের পাশাপাশি এখন মায়েরাও গড়ে তুলছে তাদের মাটির সন্তানদের। অবশ্য এখন শুধু মাটি নয়, বিদেশে পাড়ি দেওয়ার জন্য কুমোরটুলিতেই মাটির পাশাপাশি ফাইবার গ্লাস দিয়েও তৈরি হচ্ছে মূর্তি। মূর্তি তৈরির পাশাপাশি ঠাকুরের গয়না, অস্ত্র এরকম অনেক অনুসারী শিল্পও সমৃদ্ধ করেছে কুমোরটুলিকে।

যুগ বদলেছে, এসেছে নতুন শতাব্দী। আর সেই সঙ্গে বদল এসেছে কুমোরটুলিতেও। বড় চোখের দেবীমূর্তির পাশাপাশি ঘরের মেয়ের মুখের আদল এসেছে দুর্গার মুখে। সাবেকি পুজোর পাশাপাশি এসেছে থিম পুজো।আর তাই থিমের ছোঁয়াও লেগেছে দুর্গার শরীরে। তাই শিল্পীর কল্পনায় দুর্গা কখনো হয়েছেন দেশমাতৃকা, কখনো শান্তির দূত আবার কখনো নিঃস্ব, রিক্ত ঘরছাড়া পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারের বধূ, যাকে পরিস্থিতির শিকার হয়ে সন্তান কোলে হাঁটতে হয়েছে অজানা পথে। তাই বলা যায় এই মৃৎশিল্প শুধু কোন জীবিকা নয়, শিল্প মননের মূর্ত প্রতিফলন। তাই বেঁচে থাকুক শিল্প, দুধে-ভাতে বেঁচে থাকুন শিল্পী।

নিবন্ধকারঃ প্রদীপ্তা কুন্ডু 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...