বাংলার লোকায়ত দর্শন বৈচিত্রের আধার। লৌকিক বাংলা নানানভাবে এসেছে প্রদীপের ব্যবহার। জন্ম থেকে মৃত্যু সবেতেই দীপের ব্যবহার, বঙ্গ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। তেমনই দীপ দানের একটি স্ত্রীআচার হল কুল কুলতি ব্রত। পল্লী বাংলার মেয়েরা আশ্বিন মাসের সংক্রান্তি থেকে এক মাসজুড়ে অর্থাৎ গোটা কার্তিক মাস ধরে এক মাসব্যাপী এই ব্রত পালন করেন। এই ব্রত একবার পালন করলে, চার বছর পরপর পালন করতে হয়। ব্রতের উদ্দেশ্য হল মৃত্যুর পর স্বর্গে অধিষ্ঠান কামনা। পরিবারের মঙ্গল কামনাও মিশে থাকে এই ব্রতে।
বাড়ির সন্ধ্যা প্রদীপ দেওয়ার জায়গায় মাটির একটি বেদি ও ছোট গর্তের আকারে কুল কুলতি তৈরি করা হয়। বেদিতে প্রদীপ জ্বালানো হয়। গর্তে পুজোর ফুল দেওয়া হয়। বেদির পাশেই একটি তুলসী গাছ রাখা হয়। তুলসী গাছকেই দেবতা জ্ঞানে, প্রদীপ জ্বালিয়ে এবং শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে পুজো করা হয়। সঙ্গে থাকে কুল কুলতির গান। যা বাংলার ব্রত আচারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
কুল কুলতি, কুলবতি,
তোমার তলায় দিলাম বাতি
আয় কুলতি হব সাথী,
সত্যি সত্যি মাখম ফল,
অরুণ ঠাকুর বরণে,
ফুল ফুলেছে চরণে,
এই ফুলটা কে নেবে,
সাত ভাইয়ে সাবিত্রী,
কার্তিক মাসে, তুলোর রসে,
ধূপ ধূপায়ে নমঃ
ধূপ ধূপায়ে নমঃ
সন্ধ্যাবেলায় বসতবাড়ির তুলসীতলায় কুলপাতা পেতে হাতে করে প্রদীপটি ঘোরাতে ঘোরাতে ছড়া পাঁচালী গাওয়া হয়।
'কুল-কুলতি কুলবতী
তুলসীতলায় দিয়ে মাটি
আমার যেন হয় স্বর্গে বাতি।।'
প্রদীপটি তিনবার ঘুরিয়ে কুলপাতার উপর রেখে বলা হয়।
'হরিপ্রিয়া তুলসীদেবী করি নমস্কার
অন্তিমকালে কোরো মাগো ভবনদী পার।'
পরদিন সকালে ফুল, দুর্বা ও বেলপাতা সরিয়ে গোবর-জল দিয়ে কুল কুলতির জায়গাটিকে সাফ করে নেওয়া হয়। কুল কুলতি ব্রত পালনে কুলদেবী তুষ্ট হন। গৃহে শান্তি আসে, মঙ্গল আসে ও আশা-আকাঙক্ষা পুরণ হয়। পরিবারে সমৃদ্ধি আসে। যদিও আজকের ব্যস্ত জীবনে ক্রমশ এই সব লোকাচার হারিয়ে যাচ্ছে।