বঙ্গে কালীক্ষেত্রর সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। খ্যাতনামা কালীক্ষেত্র ছাড়াও এমন অনেক কালী মন্দির রয়েছে, যেগুলি খানিকটা হলেও আড়ালে চলে গিয়েছে। তেমনই ইছামতি তীরবর্তী এক জনপদ হল বসিরহাট। জনপদ হিসেবে সুপ্রাচীন বসিরহাট। সেখানেই সংগ্রামপুরে রয়েছে এক কালীমন্দির। মন্দিরটির বয়স ৬০০ বছরেরও বেশি। ছয় শতাব্দীর ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই কালীপীঠ। ইতিহাস ও ঐতিহ্যই এই মন্দিরের উপজীব্য। পলাশীর যুদ্ধ থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন, বিশ্বায়ণ থেকে করোনা সব দেখে ফেলেছে এই মন্দির। কথিত আছে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন। রাজার দান করা জমিতে কালী মন্দির তৈরি হয়েছে। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র স্বপ্নাদেশ পেয়েই মন্দির গড়ার জন্যে জমিদান করেছিলেন। যদিও একেবারে প্রথমে মন্দির আজকের মতো ছিল না। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে খড়ের চালের মন্দিরে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলেন। তারপর কালে কালে মন্দির বর্তমানের রূপ নিয়েছে। কৃষ্ণচন্দ্র কেবল মন্দির প্রতিষ্ঠা করে যাননি, একই সঙ্গে মন্দিরের পুরোহিতও ঠিক করে গিয়েছিলেন তিনি। চক্রবর্তী ব্রাহ্মণদের পূর্বপুরুষদের নিয়ে এসে গঙ্গা তীরবর্তী সংগ্রামপুরে বসতি গড়ে দিয়েছিলেন। ওই চক্রবর্তী পরিবারের সদস্যরাই বংশানুক্রমে আজও সংগ্রামপুরের কালীমন্দিরে পৌরহিত্য করে চলেছেন। অধুনা চক্রবর্তী পরিবারে আটজন শরিক। এক এক জন নয় দিন করে পুজো করেন। এই মন্দির নিয়ে কিংবদন্তির শেষ নেই। শোনা যায়, মন্দিরের পিছনের পুকুরে লালপেড়ে শাড়ি পরা ছোট্ট মেয়েকে স্নান করতে দেখেছেন অনেকেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, ওই ছোট্ট মেয়েটিই নাকি স্বয়ং মা কালী। স্থানীয় বাসিন্দাদের ধারনা, মা তাঁদের সঙ্গে, তাঁদের মধ্যেই থাকেন এবং তাঁদের সব ইচ্ছেই পূরণ করেন।
রীতি মেনে আজও সংগ্রামপুরের এই মন্দিরের এক কিলোমিটারের মধ্যে কোনও কালীপুজো হয় না। মা এখানে দক্ষিণা কালী রূপে পূজিতা হন। ভক্তদের বিশ্বাস মা খুব জাগ্রত। কথিত আছে, মা কালির সামনে থাকা ঘটটি সংগ্রামপুরেরই কোনও ব্যক্তি পেয়েছিলেন। তার উপর ভিত্তি করেই এই মন্দির গড়ে উঠেছে। তবে মন্দিরের মূর্তিটা কী দিয়ে তৈরি এবং মূর্তিটি কে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তা নিয়েও নির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই। মন্দিরে নিত্য পুজো হয়। প্রতিদিন মাকে ভোগ নিবেদনের বন্দোবস্তও রয়েছে। মাকে প্রতিদিন ভিন্ন ভিন্ন ভোগ নিবেদন করা হয় যেমন লুচি, চিড়ে, ফল, খিচুড়ি, পায়েস ইত্যাদি। কোনও কোনদিন আমিষ ভোগও নিবেদন করা হয়। যদি কোনও ভক্ত পাঁঠা বলি দিতে আসেন, তবে সেদিন বলির পর দেবীকে বলির কাঁচা মাংস নিবেদন করা হয়। মন্দিরে বলি প্রথার চল আজও রয়েছে। স্থনীয়দের বিশ্বাস, বলি প্রথা বন্ধ হলে, মা রক্তের স্বাদ পেতে গ্রামের কোনও অমঙ্গল করতে পারেন। সেই কারণ আজও মন্দিরে বলির চল রয়ে গিয়েছে।
বছরের বিভিন্ন সময় এই মন্দিরে বিশেষ বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। যেমন, ভাদ্র মাসে হয় ভাদ্র কালীপুজো, শ্যামা পুজো অর্থাৎ দীপানিতা অমাবস্যার রাতে শ্যামা কালী করা হয়, চৈত্র মাসে হয় গামাটি পুজো ও শীতলা পুজো। এছাড়া এখানে প্রতিবছর জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে কল্পতরু উৎসব, চৈত্রে চড়ক পুজো করা হয়। ৬০০ বছরের রীতি মেনে কালী পুজোর আগে নবকলেবর হয়, অর্থাৎ নতুন করে মায়ের মূর্তিতে রঙ করা হয়। মন্দিরের প্রবীণ পুরোহিত আজও জানেন না কি দিয়ে এই মন্দিরের মায়ের মূর্তি তৈরি হয়েছে। আজও মন্দির সবার কাছে রহস্যই থেকে গিয়েছে। এই মূর্তি মন্দির প্রতিষ্ঠিত হবার সময় থেকে একই রকম রয়ে গিয়েছে। কোনও সংস্কার করার প্রয়োজন পড়েনি। শুধু কালী পুজোর আগে রঙ করা হয়, সেইকারণেই আকৃতিতে সামান্য পরিবর্তন এসেছে। কালী পুজোর দিন প্রত্যেকবার মায়ের চক্ষু দানের প্রথা আছে এখানে। সকাল আটটার মধ্যে চক্ষু দান করা হয়। শিল্পী এসে মায়ের চোখ আঁকেন। পুজোর দিনে দেবী কালিকাকে ভক্তদের দেওয়া বেনারসি শাড়ী পরানো হয়। মায়ের গায়ে থাকে বিভিন্ন সোনার অলঙ্কার যেমন হার, মুকুট, চুরি, নথ, দুলসহ বিভিন্ন গহনা। দুপুরে নিত্য পুজো হয়। সন্ধ্যায় আরতির পর অমাবস্যার তিথি মেনে রাত দশটায় বিশেষ পুজো শুরু হয়। সারা রাত ধরে পুজো চলে। তৃতীয় প্রহরে পুজোর পর চতুর্থ প্রহরে অর্থাৎ ভোরের দিকে হয় বলি। তারপর আরতি ও পুষ্পাঞ্জলি হয়। এখানে দেবী প্রতিষ্ঠিত তাই যজ্ঞ হয় না। দেবীর বিসর্জনও হয় না।
কালী পুজোর দিন মাকে বিশেষ ভোগ নিবেদন করা হয়। বিশেষ ভোগের তালিকায় থাকে এঁচোড় দিয়ে মটরের ডাল, কচুর একটি ব্যাঞ্জন ও চিংড়ি মাছের একটি পদ, সঙ্গে থাকে সাদা ভাত। পাঁঠা বলির কাঁচা মাংসও মাকে নিবেদন করা হয়। ভোগের তালিকায় আজ অবধি কোনও পরিবর্তন করা হয়নি। সাধরণত কালীপুজোর সময় এঁচোড় পাওয়ার কথা নয়, তবুও প্রত্যেকবার কোনও না কোনও ভক্ত ঠিকই এঁচোড় নিয়ে মন্দিরে চলে আসেন। বলি বন্ধ করে দিলে মা ক্ষুব্ধ হতে পারেন, গ্রামে মড়ক লাগতে পারে। সেই ভয়ে সংগ্রামপুরের মন্দিরে পাঁঠাবলির রেওয়াজ অদ্যাবধি বিদ্যমান। মন্দিরে কালীপুজোর রাতে নিয়ম মেনে একটি করে পাঁঠা বলি হয়। এছাড়াও বলিদানের জন্য ভক্তরাও অনেকেই পাঁঠা নিয়ে আসেন। সারাবছর ধরেই বলি চলে। সংগ্রামপুরের মন্দির নিয়ে গল্প-গাথার অন্ত নেই। আজও এখানে কালী আরাধনা চলছে। ইতিহাসের অনন্য নজির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বসিরহাটের কালী মন্দির।