বুড়িবালামের তীরে দাঁড়িয়ে দু'চোখ ভরে দেখলাম তাকে।
সারি সারি শুধু ট্রলার আর লঞ্চ। ব্যস্ততার কোলাহল। পেশার তোড়জোড় আর পারাপারের দ্রুততা। দু'দন্ড বসার ফুসরত নেই কারোর।
যে লঞ্চে করে ওপারে যাব তা ঘাট থেকে প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরে বাঁধা।
প্রথমে কাদা পরে কোমর জল পেরিয়ে উঠতে হবে লঞ্চে। পনেরো মিনিটের মধ্যে সে নোঙর বাঁধল ওপারের গ্রাম পারিখির ঘাটে।
গ্রামের মেঠো পথ ধরে গিয়ে পড়ব সমুদ্রের বুকে। পথ ধরে যাওয়ার সময় চোখে পড়ল রাস্তার ধার ধরে জাল শুকতে দেওয়া হয়েছে। আন্দাজ করলাম জেলেদের গ্রাম।
গ্রামের সীমান্তে এসে একটি চায়ের দোকান থেকে যে যার বোতলে জল ভরে নিলাম। প্রায় ৩০ কিমি যাত্রাপথে জল পাওয়ার সম্ভাবনা একদম নেই। সমুদ্রের অফুরন্ত জল পথসাথী হলেও আমাদের ক্লান্তির বারি দেওয়ায় সে অপারগ।
একটা সময় একটানা মেঠোপথ আর ভালো লাগছিল না।
হঠাৎ চোখে পড়ল গ্রামের সীমান্তরেখা বরাবর উঁকি দিচ্ছে ঝাউবন। সেই সঙ্গে সমুদ্রের ভেসে আসা অট্টহাসি।
দু'পা গিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।
প্রকৃতি পরম যত্নে, মমতায় ছবি এঁকে রেখেছে।
একদিকে সবুজের পেলবতা আর অন্যদিকে নীলের স্নিগ্ধতা।আকাশের নীলিমা আর সাগরের নীল জলরাশি হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলেছে। তাদের হাত ধরাধরির সাক্ষী হলদে বালি। মাঝে মাঝে অবশ্য সমুদ্র সফেন।
ঢেউ আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। আমরা দশজন ছাড়া দূর-দূরান্তে কারো কোনও চিহ্ন চোখে নেই। সমুদ্রে মাঝে মাঝে ট্রলারের উঁকি। মাছ ধরার তোড়জোড়। উপকূলেও জাল পাতা দেখেছিলাম।
ঝিনুক আর লাল কাঁকড়াকে সাথী করে আমরা এগিয়ে চললাম।
কসাফল যাওয়ার বেশিরভাগ রাস্তায় ঝিনুক বিছানো রাস্তা দিয়ে হেঁটেছি আর লাল কাঁকড়াকে ভয় পেয়ে টুপটাপ নিজেদের ঘরের ভিতর ঢুকে যেতে দেখেছি।
মাথার উপরে পাখিদের গান। কলকাতায় থাকাকালীন পাখিদের গান কখনও মন দিয়ে শোনাই হয়ে ওঠে না।
অনেকদিন পর প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম।
মাস্ক, স্যানিটাইজার ছাড়া জীবন যে কত আনন্দময় তা প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। আবার পুরনো জীবনে ফিরে আমরা সবাই আনন্দে দিশাহারা। তার মধ্যে পাখিদের গান আর সাগরের যৌবনগীতি এক অদ্ভুত কোরাস সৃষ্টি করেছিল।
তাদের কনসার্ট শুনতে শুনতে কখন যে গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছি আমরা প্রায় কেউই বুঝতে পারি নি।
ঝাউবনের বাঁকঘুরে আমরা একটি গ্রামে এসে পড়লাম।
সমুদ্র এখানে অনেকটাই দূরে সরে গেছে। সমুদ্রের সমান্তরালভাবে বইছে কসাফল নদী।
আমরা যখন বাহবলপুর গ্রামের ঘাটে এসে পৌঁছই, সূর্য তখন পশ্চিমে ঢোলে পড়েছে।
কসাফল নদীর যে পাড়ে আমরা দাঁড়িয়ে সেই গ্রামের নাম বাহবলপুর। আর ওপারে কসাফল। সেদিনের রাত আমরা কসাফলে কাটাব।
বাহবালপুরের মূলত জেলেদের গ্রাম। বাসিন্দাদের বেশিরভাগই মৎসজীবী।
মাঝ ধরার পাশাপাশি অবশ্য চাষবাসও করেন। দিনে হাল-জমি-বীজরোঁয়া। আর ভোরে মেছো নৌকার ডাকে মাঝ সমুদ্রে পাড়ি।
রোজ রাত থাকতে থাকতে ট্রলার নিয়ে মাছ ধরতে বেরিয়ে যান ওরা। প্রায় দশ টনের মতো মাছ জালে ওঠে।
এতো মাছ শুধু কাঁচা হিসেবে বেচা হয় না। শুঁটকি করা হয়। সেগুলো ওড়িশায় যোগান দেওয়ার পর বাংলা, আসাম, ত্রিপুরাসহ বাংলাদেশে পাঠানো হয়। বিদেশেও যায়। চাহিদা বিপুল।
মাছ বেশিদিন সংরক্ষণ করে রাখার উদ্দেশ্যে নিয়ে শুঁটকি মাছের চল শুরু হয়ছিল। আগে নুন দিয়ে সংরক্ষণ করা হত। এখন শুঁটকি তৈরি করতে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে।
‘ফিশপ্রিয়’ ইংরেজ সাহেবদের শুঁটকি প্রীতি শোনা যায়। তাঁদের দেশে হেরিং শুঁটকি বা 'ডিবগি চিক' বেশ পপুলার। তাঁরা যখন আমাদের দেশের পশ্চিম উপকূলে আসে তখন লইট্যা শুঁটকি দেখতে পায়। অচিরেই তাঁদের কাছে তা প্রিয় হয়ে ওঠে এবং নাম দেন 'বম্বে ডাক'। নিজেদের দেশেও তা পাঠাতে শুরু করে। ইংরেজদেরও আগে পশ্চিম উপকূলে এসেছিল পর্তুগীজরা। আমরা জানি ভারতীয় তথা বাংলার রান্নায় পর্তুগীজ রন্ধনশৈলির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
তাঁদের হাত ধরে কি শুঁটকি এদেশে এসেছিল? যদিও এ বিষয়ে আমার জ্ঞান সীমিত।
বাহবলপুরে যখন আমরা পৌঁছলাম তখন প্রায় বিকেল পাঁচটা বাজে। সন্ধ্যে ৬:৩০ নাগাদ একটা ভুটভুটি এল। আমরা তাতে চেপে বসলাম।
কুড়ি মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম কসাফল। সেদিনের রাতের ঠিকানা কসাফল জেটি।
আস্তানা ঠিক করে জিনিসপত্র রেখে খাওয়া-দাওয়ার তোড়জোড় শুরু হলো। সে রাতটা নিজেদেরই রান্না করতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল রান্নার আয়োজন।
সকলে মিলে হইহই কর রান্না করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। (চলবে)