আমাদের ভুটভুটি কসাফলের তীর ছুঁলো।
ঘড়ির কাঁটা পৌনে সাতটার ঘরে এক্কা-দোক্কা খেলছে। চারিদিকে অন্ধকার। ঘাটে মাঝিদের ফিসফাস আর আগত যাত্রীদের গুনগুন। দূরে আঁধার চিরে জোনাকির মতো মিটমিট করে আলোর কাটাকুটি। ঠান্ডা হাওয়া মাঝে মাঝে গালে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। আজকে আমাদের দশজনের রাতের আস্তানা জেটি।
মাথার উপরে ছাদ থাকলেও চারিধার খোলা। আলোর তো প্রশ্নই নেই। মোমবাতি আর টর্চ জ্বালিয়ে আলোর বন্দোবস্ত করা হল। কোনরকমে পাতা জোগাড় করে জায়গাটা ঝাঁট দেওয়া গেল।
তারপর ম্যাট পেতে প্রস্তুত হল আমাদের বিছানা। চারিদিকে প্ল্যাস্টিকের শিট দিয়ে ঘিরে ফেলা হল। তারপর শুরু রান্নার তোড়জোড়।
ডিনার সেরে সবাই স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পড়লাম।
শ্রমিক মৌমাছি যেরকম গুনগুন করে নিজেদের কাজ করে ঠিক সেইরকম শব্দে হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল।
চোখ মেলে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। কুয়াশার সাদা চাদর মুড়ি দিয়েছে কসাফল নদী। সাদা চাদর চিরে ইতঃস্তত নৌকা বাঁধা। ঘাটের ধারে হাঁটু মুড়ে বসে আছে এক বৃদ্ধ ন্যুব্জ বটগাছ। যদিও তার কাছে এই দৃশ্য নতুন নয়।
হয়ত রোজ রোজ একই দৃশ্য দেখে সে ক্লান্ত। আর আমার কাছে ভোরের এই দৃশ্য এক টুকরো অবকাশ। এই দৃশ্য দেখার জন্যই তো কষ্ট করে এত দূর এসেছি।
মাঝরাতের ট্রলার বাড়ি ফিরছে।
"ও মাঝি কত মাছ ধরলে গো", না এরকম কোনও কথা তাদের বলা হয় নি। জেটির পিছনদিকে ঝাউবন।
ঝাউবন পেরিয়ে কসাফলের সমুদ্র। জেটির আশেপাশে রয়েছে সরকারি কোয়ার্টার। পরিত্যক্ত এই কোয়ার্টারগুলোর বয়স বেশি না হলেও তাদের করুণ ও মলিন চেহারা বলছিল তারা বড্ড অসহায়।
কয়েকটা জেলেদের মাটির বাড়িও ছিল।
সকালে খাওয়া দাওয়া সেরে বেরতে বেরতে প্রায় দুটো বেজে গেল। যাঁরা এখানে ট্রেকিং-র জন্য আসেন, তাঁরা মূলত সকাল-সকাল বেরিয়ে পড়েন। রাস্তা প্রায় ৩৫ কিমি।
আমাদের ইচ্ছে ছিল রাতে চাঁদকে সাক্ষী রেখে সমুদ্রের বুকে দাপাদাপি করার। আমরা বেরিয়ে তো পড়লাম। তখনও কেউ জানিনা আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে! ঘুণাক্ষরেও আমরা টের পাই নি।
কসাফলের সমুদ্র উপকূলে ভাসমান তেল সেভাবে চোখে পড়েনি। লাল কাঁকড়ার সংখ্যাও তুলনায় কম। ঝিনুক বিছানো রাস্তাও এবার স্বাগত জানায়নি আমাদের।
সাগর এখানে বেশ শান্ত। তর্জন-গর্জন অনেক কম। আমরা হাঁটা শুরু করলাম।
সামনে অনেকটা রাস্তা, আর আমরা বেরিয়েছিও দেরিতে। তবে ভেবেছিলাম, সাতটার মধ্যে ডাগারা পৌঁছে যাব। মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। বাকি পথটা ঠিক কেমন হতে পারে তার কোনও আন্দাজ আসেনি মাথায়।
যাই হোক পথ খুবই মনোরম ছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে রোদের তেজ ম্লান হয়ে এল।
তিরতির করে ভেজা বরফ ঠান্ডা হাওয়া জ্যাকেট ভেদ করে শরীর ছুঁতে চাইছিল। তবে আমরা সবাই একটা ওম পাচ্ছিলাম। এতদিন পর মুক্তির ওম। খোলা আকাশের ওম। নীল-সবুজের প্রেমের ওম।
সূয্যি মামা কমলা বসন পড়ে সারাদিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে পশ্চিমে পাটে বসেছেন বিশ্রাম করতে, আমরাও খিদেয় ক্লান্ত হয়ে সমুদ্রের তীরে বসে পড়লাম। সাগরের ধারে সূর্য্যকে সাক্ষী রেখে ‘লাঞ্চ’। এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম।
লাঞ্চ মিটতেই আবার হাঁটা শুরু। রাস্তা যে অনেক।
বিকেল পাঁচটা নাগাদ আমরা একটি নদীর ধারে এসে পৌঁছালাম।
সমুদ্র এখান থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে। নদীর কাছে পৌঁছতেই এক মাঝি আমাদের জানায় নদী তাড়াতাড়ি পার হতে হবে। এখন নদীতে পায়ের পাতা সমান জল হলেও জোয়ারের জল ঢুকলে কোমর ছাড়িয়ে যাবে। নদীটা বেশ চওড়া। নদীর মাঝে তো একদম জল নেই।
ভাবাই যায় না, যে কিছুক্ষণের মধ্যেই এই নদী কোমর সমান জলে ভরে যাবে। দশজনের মধ্যে আমরা চারজন নদীর কাছে এসেছিলাম। বাকিরা তখনও দূরে।
জানতে পারলাম, দশ কিমি দূরে একটি খাড়ি আছে সেটাও জোয়ারের জলে কোমর ছাড়িয়ে যাবে।
ঘন্টাখানেকের মধ্যে সেই খাড়ি পার না হতে পারলে সেদিনের রাতের ঠিকানা সমুদ্র সৈকত।
আমাদের মধ্যে একজন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে রইল পিছনের টিমকে খবরটা দেওয়ার জন্য। আমরা তিনজন নদী পার করতে লাগলাম। খানিকক্ষণ পরে দেখলাম পিছনের টিম ঢুকে গেছে। সবাই হইহই করছে তাড়াতাড়ি হাঁটার জন্য। যেভাবে হোক ঘন্টা খানেকের মধ্যে খাড়ি পার হতেই হবে।
তবে টিম ঠিক করল পার হতে না পারলে সমুদ্রের বুকে রাত কাটাবে। রাতের মতো খাবার আমাদের সঙ্গে ছিল।
টিমের একজন অত্যাধিক হাঁটার জন্য ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। আমি আবার আগের দিন গোড়ালিতে ছোট পেয়েছিলাম। ব্যাথাও বেশ ভালই।
কিন্তু খাড়ি পেরনোর কথা শুনে আমার গোড়ালির ব্যথা গায়েব! আর যে ক্লান্ত ছিল সেটাও ‘স্টেডি’।
সন্ধ্যা ছ'টা নাগাদ আমরা একটা গ্রামের কাছে এসে পৌঁছলাম। দু'জন ব্যক্তি জানাল আরও কিছুটা দূর এবং তাড়াতাড়ি গেলে এ যাত্রা আমরা পার হয়ে যেতেও পারি।
টর্চ নিয়ে সবাই প্রায় হনহন করে হাঁটতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর কিছু মানুষের আওয়াজ শোনা গেল। তাঁরা খাড়ি পেরিয়ে আমাদের দিকে আসছেন।
তাঁদের কাছেই জানতে পারলাম জোয়ারের জল ঢুকছে...
যেদিকে আমরা যাচ্ছিলাম সেদিকে যেতে বারণ করলেন, জল ততক্ষণে ঢুকে গিয়েছে।
ওঁরা সেই জায়গা থেকে আমাদের আরেকটু দূরে যেতে বললেন, ওখানে তখনও সেভাবে জল ঢোকেনি।
আমরা খাড়ির কাছে পৌঁছলাম। জল দেখে মনে হল হাঁটু ছাড়িয়ে আছে। পা ঠেকাতেই হাড়ে হাড়ে টের পেলাম ঠাণ্ডা কাকে বলে!
আমরা টর্চ জ্বালিয়ে দু'জন দু'জন করে হাত ধরে পার হলাম। খাড়ি পেরনোর পর এক অদ্ভুত শান্তি!
কপালের ভাঁজগুলো রাতারাতি গায়েব!
যাক, রাতে আর সমুদ্রবাস করতে হবে না। ভেবেই নিশ্চিন্তি!
এবার একটু ‘রিলাক্স’ করে সবাই হাঁটতে লাগল।
আমাদের চোখের সামনে আস্তে আস্তে উন্মুক্ত হচ্ছে প্রকৃতি। কী তার রূপ! কী তার মায়া!
দুধ জ্যোৎস্নার আলোয় ভিজে গিয়েছে গোটা সৈকতটা। অন্ধকারের নিস্তব্ধতাকে আরও গাঢ়। সেই স্তব্ধতা খানখনা হয়ে যাচ্ছে শিগাল পাখির খিলখিলে হাসিতে।
সাগরের দীর্ঘশ্বাস পথে পথে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিঠোফেনের সুর। রাতের সফরযাত্রীকে স্বাগত জানাতে দূরে যেন কেউ ইমন কল্যাণ বাজিয়ে চলেছে।
এত আয়োজন আমাদের জন্য, তারপরও আমাদের ভালো লাগছিল না।
পথ শেষ হতে চাইছে না। সবাই ক্লান্ত বিধ্বস্ত। জলও শেষ হয়ে এসেছে। মাঝে মাঝে মরীচিকার মতো আলো দেখা গেলেও সে শুধুই আলেয়া।
‘আর কতদূর’- এই আপ্তবাক্য তখন সবার মুখে।
রাত তখন ন'টা। বাতাসের বরফ ঠাণ্ডা চাপটা আরও একটু জোরালো হয়ে গা কামড়ে বসেছে। অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর। খিদে-তৃষ্ণায় সবাই মরিয়া।
কলকাতায় ন'টা মানে রাত হতে এখনও অনেক দেরি। আর এই অচিন বেলাভূমে রাত ন'টা মনে হচ্ছে মধ্য রাত্রি।
দলের একজন বলল ডাগারা ঢুকে গিয়েছি। সমুদ্রের ধারের বসার জায়গা দেখা যাচ্ছে। আমি আর একজন তখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না। তারপর একটি রাস্তায় উঠলাম। দূরে আলো দেখা গেলেও চোখে অন্ধকার লেগে। সব ধাঁধিয়ে গিয়েছে। কিছু দেখতে আর বুঝতে পারছি না।
তবে রাস্তা দেখে বুঝলাম, লোকালয়ে চলে এসেছি। আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গেস্ট হাউসে ঢুকব। কিন্তু এই পাঁচ মিনিটের রাস্তা আর পেরতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছে হামাগুড়ি দিলে ভালো হয়।
আমরা তিনজন যখন ডাগারা ঢুকছি তখন রাত সাড়ে ন'টা। বাকি সাতজন তখনও অনেকটা দূরে। আমাদের দু'জনকে গেস্ট হাউসে ছেড়ে আমাদের এক সঙ্গী বেরিয়ে গেল বাকিদের আনতে।
গেস্ট হাউসে ঢুকে সটান শুয়ে পড়লাম। পা চলছেনা। ঘাড় ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে...
ধকলের চোটে মনে হচ্ছিল ‘আর কখনও ট্রেকিং-এ আসব না’। টাকা খরচ করে এত কষ্ট সহ্য করা যায় না।
প্রায় ১৫-২০ মিনিট পরে সেকেণ্ড টিম ঢুকল। তাদের অবস্থাও আমাদের মতো শোচনীয়। ব্যাগ রেখেই লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। রাতে কোনরকমে খেয়ে আমরা সব সবাই যে যার বিছানায় শুয়ে পড়লাম।
পরেরদিন দুপুরে ডাগারা কাটিয়ে রাতে আমাদের ট্রেন।
ডাগারা বেশ নিরিবিলি। সেইভাবে ট্যুরিস্ট স্পট এখনও গড়ে ওঠেনি। সেখানে আরও দুটো ট্রেকিং টিমের সঙ্গে দেখা হলো। যাঁরা নির্জন পছন্দ করেন তাঁদের জন্য ডাগারা বেশ ভালো। কোস্টাল ট্রেকিং রুট হিসেবেও বেশ ভালো। বিকেলে ক্যাম্প ফায়ার হল।
আগের দিন মনে মনে ভেবেছিলাম ‘আর ট্রেক করব না’। সেদিন সন্ধের নেশা-নেশা ক্যাম্প ফায়ারে সেই ইচ্ছে পুড়ে ধোঁয়া। ক্লান্তিহীন। বিরক্তিহীন। মন জুড়ে তখন শুধুই মনখারাপ...
গভীর রাতে ডাগারা যখন ঘুমচ্ছে তখন আমরা পাড়ি দিলাম কলকাতার পথে। হাওড়া স্টেশন থেকে হেঁটে যখন বাড়ির পথে রওনা দিলাম সূর্য তখন মেঘের আড়ালে উঁকি দিচ্ছি। সমুদ্রের সেই কমলা রাঙা সূর্য শহরেও। শহরের মতো সেও ঘড়ির কাঁটার শাসনাধীন। (সমাপ্ত)