শিশু সময় মতো কথা বলতে না শিখলে পুজো করা হয় এই দেবতার

বাঁকুড়ার রাইপুর অঞ্চলকে ঘিরে রয়েছে একটি জনশ্রুতি। একবার এক যুবক নাকি একটি পুজো স্থান থেকে একটি পোড়ামাটির হাতির মূর্তি চুরি করে পালাচ্ছিল। রাতের আকাশে তারাদের দেখানো আলোয় সে বন-জঙ্গল পেরিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল পোড়ামাটির মূর্তি চুরি করে। স্থানীয় যুবকটি চুরি করলেও তার ভয় ছিল ধরা পড়ে যাওয়ায়। পালানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই সে অনুভব করতে থাকে অন্ধকার রাতে নিস্তব্ধতা ছাড়াও অন্য কেউ যেন তার পিছু নিয়েছে। শান্ত বাতাসের সঙ্গে মাঝে মাঝে কেউ যেন তাকে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে সে শুনতে পাচ্ছে একটা শোঁ শোঁ শব্দ। এই শব্দের সঙ্গে ছেলেটা অনুভব করতে থাকে কেউ যেন ওর সঙ্গে ক্ষিপ্র গতিতে ছুটছে। ছেলেটা তবুও বুকের কাছে পোড়ামাটির মূর্তিটা চেপে ধরে থাকে। ও যত মূর্তিটাকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে ওর কানে আসতে থাকে বিরাট গর্জন। ও জানে থেমে গেলেই বিপদ বাড়বে। ওকে এখনই কোনও হিংস্র জানোয়ারের কবলে পড়তে হবে। এবার ভয় পেতে শুরু করে ছেলেটা।  

 

জনশ্রুতি এই যে কেউ ওই ছেলেটাকে ক্ষিপ্র গতিতে পিছন দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। অথচ খালি চোখে কাউকেই দেখা যায় না।একটা অদৃশ্য শক্তি ছেলেটাকে সেই পুজো করার থানের কাছে নিয়ে যায় যেখান থেকে সে পোড়ামাটির হাতিটা চুরি করেছিল। ভয়ের কাছে অবশেষে হেরে যায় লোভ। ছেলেটা দেখতে পেয়েছিল একটা হিংস্র বাঘকে। বুঝতে পেরেছিল ওকে কঁকা ঠাকুর তাড়া করেছে। বাঘরূপী এই ঠাকুরের বাহন হিসেবে কল্পনা করা হয় পোড়া মাটির হাতি-ঘোড়া ছলন মূর্তিকে। ছেলেটা পুজো করার থান থেকে মূর্তি তুলেছিল বলেই নাকি এই কঁকা ঠাকুর তার পিছু নিয়েছিল।

 

শোনা যায় কঁকাঠাকুরের উদ্দেশে প্রণাম করে হাতে ধরা পোড়া মাটির হাতিটা যত্ন করে দেবীর ধানে রেখে দিলে বাঘটা উধাও হয়ে যায়। বাতাসে মিশে যায় সব ভয়। বাঁকুড়া জেলার রাইপুরের রায়পুর বাজার চত্বরে মা বাসুলি থানের কাছেই একটা বাঁধাই করা গোল স্থান রয়েছে। এখানেই স্তুপাকৃতি হাতি-ঘোড়ার ছলনমূর্তি সাজানো থাকে। এই অংশকেই কঁকা ঠাকুর রূপে কল্পনা করা হয়। মূলত জন্মের পর যদি কোন শিশু কথা বলতে না পারে কিংবা কোন মহিলা যদি সন্তানসম্ভবা হতে না পারে তখন কঁকা ঠাকুরের থানে এসে মানত করে সকলে। শোনা যায় এই দেবতা কৃপা করলে কথা বলতে না পারা বাচ্চা সেরে ওঠে এবং ঈশ্বরের আশীর্বাদে নাকি বন্ধ্যাত্ব দূর হয়।

 

এই দেবতাকে পুরুষ দেবতা হিসেবে কল্পনা করা হয়। তবে মূলত বাঘ রূপে কল্পনা করা হয় কঁকা ঠাকুরকে। বাঘের উল্লেখ থাকলেও কঁকা ঠাকুর কিন্তু এখানে শিশু রক্ষক এবং পোড়ামাটির হাতি ঘোড়া মূর্তির রক্ষক হিসেবে পুজিত হন। আনুমানিক দেড়শ বছরের বেশি সময় ধরে বাঁকুড়ার রাইপুরে এই কঁকা ঠাকুরের পুজো হয়ে আসছে। ‌ শোনা যায় বংশ পরম্পরায় এই পুজোর দায়িত্বে রয়েছেন সুধীর লোহার-এর পরিবার। সুদীপ লোহার-এর বাবা রমনাথ লোহারকে কঁকা ঠাকুর স্বপ্নে আদেশ দেন তাঁর থান তৈরি করে পূজা করতে। তারপর বংশ পরম্পরায় তাঁদের উত্তরসূরীরাই এই দেবতার পূজো করে আসছেন।

 

মূলত মকর সংক্রান্তি ঠিক পরের দিন পহেলা মাঘ এই ঠাকুরের পূজা করা হয়। এছাড়া আশ্বিন মাসে দুর্গাপুজোর সময় নবমীর দিন কঁকা ঠাকুরের পূজা করা হয়। এছাড়াও প্রত্যেক সংক্রান্তিতে রায়পুর বাজারের এই থানে কঁকা ঠাকুরকে পুজো দেওয়া হয়। নিত্য পুজোর চল নেই এই ঠাকুরের। তবে কেউ মানত করলে যে কোন সময়ই পুজো দেওয়া যায়।



পুজোর উপকরণ বলতে চিড়ে, গুড়, দুধ, ফল, কলা পাতা আর চিনি। শোনা যায় এই লোহার পরিবারের কারোর উপর দেবতার ভর হয় পূজোর সময়। ভরের সময় নাকি সেই ব্যক্তি ঘাড় নিচু করে থাকে। তারপর বাঘের মতো বসে এসে সামনের দুটো হাত দিয়ে ক্রমাগত মাটি চাপড়ায়। এই ঠাকুরের পুজোয় চার রকম বলির চল রয়েছে। ছাগল, আখ, শসা চাল কুমড়ো বলি দেওয়া হয়। অনেকে মানত করলে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে পোড়ামাটির হাতি বা ঘোড়ার চলন মূর্তিও দেয়। প্রসাদ হিসেবে চিড়ে, গুড়, দুধ মিষ্টি ফল পায়ে ভক্তরা।

 

শোনা যায় ঠাকুরের উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত পোড়ামাটির ছলন মূর্তি কেউ চুরি করে নিয়ে গেলে তাকে নাকি কোন অদৃশ্য জাদুবলে কঁকা ঠাকুর তাঁর থানের সামনে টেনে নিয়ে এসে মূর্তিটি ফেরত দিতে বাধ্য করেন। কিছু স্থানীয় মন্ত্র এই দেবতার উদ্দেশে জপ করা হয়। এই লৌকিক দেবতা ওই অঞ্চলের মানুষের আপনজন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...