বাংলা ও বাঙালির অন্যতম পরিচয় রকমারি খানা। গোটা পৃথিবীর কাছে বিস্ময় হল বাংলার মিষ্টি। এবারেও বিশ্বের সেরা মিষ্টিদের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে বাংলার তথা কলকাতার তিন প্রতিষ্ঠানের মিষ্টি। রয়েছে কেসি দাসের রসগোল্লা, ফ্লুরিজের রামবল এবং বলরাম মল্লিক অ্যান্ড রাধারমণ মল্লিকের সন্দেশ। ২০২৩-র পর ২০২৪ সালেও স্থান পেয়েছে এই তিন মিষ্টি। ২০২৩ সালে তিন মিষ্টির স্থান ছিল যথাক্রমে ২৫, ২৬ এবং ৩৭। এবার স্থান হয়েছে ২৪,২৫ ও ৩৫।
রসগোল্লা হল বাঙালির পরিচয়। নবীনচন্দ্র দাশের হাতে তার জন্ম। সেই কারণে নবীন ময়রাকে রসগোল্লার কলম্বাস বলে গিয়েছেন কমলকুমার মজুমদার। বিশ্বের সেরা মিষ্টির তালিকায় ২৪ নম্বরে উঠে এসেছে কেসি দাশের রসগোল্লা। তাদের রসগোল্লা রসগোল্লা ধবধবে সাদা ও স্পঞ্জি।
কটেজ চিজ অর্থাৎ দুধ কাটিয়ে ছানা তৈরি করে, গোল্লা পাকিয়ে চিনির রসে ফেলে তৈরি হয় রসগোল্লা।
নবীনচন্দ্র দাশ রসগোল্লা সৃষ্টি করেন ১৮৬৮ সালে। তাঁর পুত্র কেসি দাশ অর্থাৎ কৃষ্ণচন্দ্র দাশ ১৯৩০ সালে কেসি দাশ বাজারে আনেন ক্যানবন্দি রসগোল্লা। ক্যানবন্দি রসগোল্লা গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে কেসি দাশের পুত্র সারদাচরণ দাশের হাত ধরে। তিনিই যন্ত্রের মাধ্যমে রসগোল্লা উৎপাদন শুরু করেন।
২৫ তম স্থানে জায়গা করে সুইস বেকারি ফ্লুরিজের রামবল। ১৯২৬ সালে জোসেফ ফ্লুরি ও ট্রিঙ্কা শহরের বুকে খোলেন 'ফ্লুরিজ অ্যান্ড ট্রিঙ্কাজ'। এক বছরের মধ্যেই ফাটল ধরে, ফ্লুরি ফ্লুরিজ চালাতে থাকেন। ট্রিঙ্কা খোলেন ট্রিঙ্কাজ। ফ্লুরিজ শহরের অন্যতম প্রাচীন টি-রুম। রামবল আদ্যন্ত ডেজার্ট। বড়দিনে শহরের প্রায় সব বেকারিতেই এর দেখা মিলত। কেক, চকোলেট আর রাম এই তিন বস্তুতে তৈরি হয় রামবল। দেখতে গল্ফ বলের মতো। ভিতরে ড্রাই ফ্রুট দেওয়াও হয় কোথাও কোথাও। উপরে থাকে চকোলেটের প্রলেপ। গোল আকার ও রামের ফ্লেভার রামবল নামকরণের কারণ।
বলরাম মল্লিক অ্যান্ড রাধারমণ মল্লিকের সন্দেশ তালিকার ৩৫ তম স্থান পেয়েছে। হুগলির কোন্নগরে মল্লিক পরিবারের পারিবারিক মিষ্টির ব্যবসা ছিল। ১৮৮০ সাল নাগাদ কলকাতায় চলে আসেন কুড়ি বছর বয়সী গণেশচন্দ্র মল্লিক। উত্তর কলকাতার এক মিষ্টির দোকানে তিন বছর কারিগর হিসাবে কাজ করার পর, নিজে মিষ্টির দোকান খুলবেন স্থির করেন গণেশচন্দ্র। উত্তর কলকাতায় তখন দিকে দিকে মিষ্টির দোকান, গণেশচন্দ্র দক্ষিণ কলকাতাকে বাছলেন।
ভবানীপুর অঞ্চলে তখন ধনীদের বসবাস। ভবানীপুরেই দোকান খুললেন গণেশচন্দ্র। ভবানীপুরে মাড়োয়ারি ব্যবসায়ি পরিবার হরলালকাদের কাছ থেকে জমি ভাড়া নিয়ে ছোট্ট একটা দোকান শুরু হল।
১৮৮৫ সালের ঘটনা, নিজেই মিষ্টি বানিয়ে বিক্রি করতেন গণেশচন্দ্র মল্লিক। গণেশচন্দ্রর মিষ্টির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে অচিরেই। গণেশচন্দ্র মল্লিকের পর সেই ব্যবসার ভার নেন বলরাম মল্লিক এবং ছেলে রাধারমণ মল্লিক। বলরাম মল্লিক অ্যান্ড রাধারমণ মল্লিকের নামেই ব্যবসা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
সন্দেশ তো কোনও একটি বা দুটি মিষ্টি নয়। মিষ্টির এক গোত্রের নাম সন্দেশ। দুধকে ছিন্ন করে সৃষ্ট ছানাকে সহজে এন্ট্রি দেয়নি বাংলা। দেবসেবায় ছানাকে প্রত্যাখান করেছিল তামাম আর্যাবর্ত। তখন নারকেলে সন্দেশ ছিল বিখ্যাত। এর পর ছানা বঙ্গ ব্যয় করে। এর জন্য কৃতজ্ঞতা জানাতে হয় পর্তুগিজ ও ওলন্দাজদের। তারা ভারতে এসে চিজ খুঁজছিল। চিজ ছাড়া যে বাবুদের চলত না। দুধ কেটে ছানার জল সরিয়ে চিজ বানিয়ে ফেলল রোলান্ডর দেশের লোকেরা। এদেশের মাটিতে নিজেদের কলোনি ব্যান্ডেলের নামে ব্যান্ডেল চিজ নাম রাখল। দুধ কেটে তারা মিষ্টিও বানাতে শুরু করল। বাঙালিরা খানিক দূরেই থাকল প্রথমটায়। নৈব নৈব চ মনো ছেড়ে একদিন কাছে টেনে নিল ব্যান্ডেল চিজকে। স্বাদের জন্য নোনতা চিজে দিয়ে দিল চিনি, গুড়। অন্যদিকে, ওলন্দাজ পাদ্রিদের থেকে জার্মান পট-চিজ তৈরির কায়দাকানুন শিখা হয়ে গেল বাংলার ময়রাদের। অশ্বমেধের ঘোড়া ছোটালেন ময়রারা। ছানার সন্দেশের জন্ম হল।