তিলোত্তমার কৈলাস

প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী, সুদূর হিমালয়ের কৈলাস পর্বতেই দেবাদিদেব মহাদেব অবস্থান করেন। অন্যান্য দেবতারাও থাকেন, বলা যায় ওটাই স্বর্গরাজ্য। শুধু হিমালয় নয়, খাস কলকাতাতেই রয়েছে আরও এক কৈলাস। তবে তিলোত্তমার এই কৈলাস মহাদেবের নয়, খিদিরপুরের ঘোষাল রাজপরিবারের ভূকৈলাস।

ভূকৈলাস নিয়ে বলছি, তার আগে ঘোষাল পরিবারের ইতিহাস জেনে নেওয়া যাক। বয়সে তিনশো বছরেরও অধিক পুরনো এই ভূকৈলাস। যদিও ঘোষালরা প্রথম থেকেই খিদিরপুরের বাসিন্দা ছিলেন না, এই পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল মধ্য কলকাতাতেই। তিনশো বছর আগের কথা, এর মধ্যেই কলকাতায় পা রেখেছেন লালমুখো ইংরেজরা। জাঁকিয়ে বসতে শুরু করে ব্রিটিশরা। নিজেদের কর্তৃত্ব কায়েম করতেই বাড়ি, দোকান, ব্যবসা ইত্যাদি বাড়াতে, গেড়ে বসার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরির পাশাপাশি সেনা ছাউনি তৈরিতেও মন দেয় সাহেবরা। ১৭৭৩ সালে তৈরি হয় ফোর্ট উইলিয়াম। কিন্তু এই ফোর্ট উইলিয়াম তৈরির কারণে বিপদে পড়েন সেখানকার আদি বাসিন্দারা। কারণ দুর্গ স্থাপনের জন্য বিপুল জায়গার প্রয়োজন ছিল। বাড়ি-ঘর ছেড়ে সেখানকার আদি বাসিন্দারা অন্যত্র চলে যান। সেই আদি বাসিন্দাদের মধ্যেই অন্যতম এক পরিবার ছিল ভূকৈলাসের ঘোষালরা। আদি বাসস্থান হারিয়ে খিদিরপুরে এসে শেষে ঘাঁটি গাড়ে এই পরিবার।

আঠেরো শতক থেকেই ঘোষালদের সুদিনের শুরু। তাঁদের প্রভাব, প্রতিপত্তির শুরু হয়। ভূকৈলাসেরও শুরু সেই সময় থেকে; সেই সময় মহারাজা জয়নারায়ণ ঘোষাল ভূকৈলাসের নামকরণ করেন। শুধু ভূকৈলাসই নয়, মহারাজা জয়নারায়ণ ছিলেন সবদিক থেকেই সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা এক মানুষ। বাংলা ছাড়াও হিন্দি, ইংরাজি, আরবি, ফারসি ইত্যাদি ভাষা রপ্ত করেছিলেন মহারাজ। একদা পুলিশ হিসেবেও কাজ করেছিলেন তিনি। তদানিন্তন পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্ট জন শেক্সপিয়ারের সহকারী হিসেবেও কাজ করেছিলেন জয়নারায়ণ। তাঁর কর্মদক্ষতা, ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর অনুগত্যে মুগ্ধ হয়ে বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংসের অনুগ্রহে তিনি মহারাজা উপাধি পান। ভূকৈলাসের রাজপ্রাসাদ এবং দুটি বড় সরোবর তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জয়নারায়ণের পরিবারের উত্তরাধিকাররা; কালীচরণ, সত্যশরণ, সত্যানন্দ প্রমুখরাও পেয়েছিলেন রাজা উপাধি। তবে সত্যানন্দ ঘোষালের পর তাঁর বংশের আর কেউ রাজা বা রায় বাহাদুর উপাধি পাননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁদের প্রতিপত্তিতে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি।​ তাঁর ইচ্ছা ছিল, এই কলিযুগে ইহলোকে আরও একটা 'কৈলাস' তৈরি করবেন তিনি। যেখানে সমস্ত দেবতারা একত্রে অধিষ্ঠান করবেন। যেই ভাবা, সেই কাজ। বিত্তবানের ইচ্ছেই কর্ম!

একে একে শিব, গঙ্গা, কার্তিক, গণেশ, সূর্য, কালভৈরব ইত্যাদি দেবতার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু হয়। প্রতিষ্ঠিত হল রক্ত-কমলেশ্বর, রাজ-রাজেশ্বর, কৃষ্ণ-কমলেশ্বর নামের তিনটি শিবলিঙ্গ। জয়নারায়ণের ইচ্ছা অনুযায়ী, মর্ত্যেই নেমে এল নতুন কৈলাস, যা পরিচিতি পেল ভূকৈলাস নামে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, মিথ সমস্ত কিছু নিয়ে তিনশো বছরেরও বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছে এই ভূকৈলাসের ঘোষাল পরিবার। ১৯৯৬ সালে কলকাতা পৌর সংস্থার হেরিটেজ তকমাও পেয়েছে এই মন্দিরটি। আজ রাজা এবং রাজত্ব না থাকলেও, কলকাতার সমৃদ্ধ ইতিহাসের অন্যতম অঙ্গ হয়ে রয়েছে ভূকৈলাস। আজও নিত্যদিন পুজো হয় এই বিগ্রহদের। বিশেষ বিশেষ তিথিতে এখানে আজও মেলা বসে। জনসমাগম হয়, কলকাতার ইতিহাসের অনন্য নজির হয়ে খাস তিলোত্তমার বুকে ভূকৈলাস আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...