ধরা দিয়েও অধরাই শেফালি

জীবনের শুরুটা সহজ ছিল না। ওপার বাংলা থেকে উৎখাত হওয়া পরিবারটি আশ্রয় নিয়েছিল মহানগরীর বুকে।

কখনও রেল লাইন কখনও  বা পরিচিতের বাড়ি। শেষ পর্যন্ত উল্টোডাঙ্গা। কিন্তু অভাবের তাড়না। পাড়াতুতো এক দিদির হাত ধরে এলেন চাঁদনি চকে। পেট ভাতের চুক্তিতে এক অ্যাংলো পরিবারে পরিচারিকার কাজ।  

 সদ্য কিশোরী আরতির কাছে আর কোন উপায়  ছিল না পরিবারকে সুরাহা দেওয়ার।

একদিন চাকা ঘুরল। সুযোগ এল অন্য জীবনের। তোরঙ্গ গুছিয়ে নিজভূম ছেড়ে আসা কিশোরী পা রাখল মহানগরের রাজপথে। নাচের টান। সুরের ছন্দ যে আগুন জ্বালিয়ে ছিল শিরায় শিরায় সেই আগুনই ঘরছাড়া করল এগারোর আরতিকে।

অ্যাংলো গায়ক ভিভিয়ান সঙ্গে সে পা রাখল ফিরপোজে। শুরু হল এক অন্য জীবন। টিমটিমে কুপির আঁধার থেকে অনেক দূরে। ঠিকরে ওঠা ঝাড়বাতির চলকে ওঠা আলোয়।

বিলাসবহুল হোটেলের রুম। ঘড়ির কাঁটায় জীবন। আরতি থেকে ‘মিস শেফালি’ হয়ে ওঠার অধ্যায়। একটা আধটা নয়, সতেরোটা আলাদা আলাদা ডান্স ফর্ম শিখেছিলেন। নক্ষত্র হয়ে ওঠাই যেন অমোঘ নিয়তি।   

ষাট দশক সত্তর দশক যুগ কলকাতায় শেফালি যুগ। কলকাতায় রাত নামত তাঁর নামে। কিন্তু সহজ ছিল না সেই চলার পথ। গোলাপ বিছানো তো নয়ই, বরং চোর কাঁটায় ভরা।

ফ্লরিজ, গ্রেট-ইস্টার্ন থেকে শুরু করে এই শহরের প্রায় সব পাঁচতারা হোটেলে। উত্তম কুমার থেকে সত্যজিৎ রায় নাচের টানে অনেক বিখ্যাতই আসতেন ফিরপোজ হোটেলে। রাতপরী শেফালিকে এক ঝলক চোখের দেখা দেখতে। কলকাতার ক্যাবারে কুইন। কলকাতার প্রথম বাঙালি ক্যাবারে ডান্সার।

ডান্স ফ্লোর থেকে থিয়েটারের মঞ্চে এসেছিলেন শেফালি। তাঁকে থিয়েটারের ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন তরুণ কুমার।

হোটেলের বলরুম থেকে মঞ্চ যেখানেই তিনি পা রেখেছেন সেখানেই আপন রশ্মিতে চোখ ধাঁধিয়েছেন আশপাশের। সেই বিচ্ছুরণে ঢেকে গিয়েছে উপচে পড়া আলোর নিচের অন্ধকারটুকু। নটী জীবনের পরিশেষ।

তিনি বলেছিলেন, দেখছ দেখো, প্রাণ ভরে দেখো। কিন্তু ছুঁয়ে দেখার সাহস করো না, হাত বাড়িও না আমার দিকে।”

ষাটের কলকাতার রাতপরীকে হাজার চেষ্টা করেও ছোঁয়া যেত না।ধরা দিয়েও শেফালি অধরাই।

 শীত কুয়াশার ছাপসা ভোরে সেভাবেই তাঁর ঝরে যাওয়া। নিঃশব্দে।

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...