ধর্মতলা, নামটা শুনলেই কি মনে পড়ে বলুন তো? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, মিটিং,মিছিলের স্লোগানের চিৎকার, কেনাকাটা নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতার দরকষাকষি, আর দূরপাল্লার বাসের আনাগোনা। শহরের প্রাণকেন্দ্র এই ধর্মতলা যেন কলকাতা প্রিয় মানুষের আবেগের ডাকনাম। রাজকীয় আভিজাত্য বহনকারী নামীদামী হোটেল থেকে ফুটপাতের ঘরকন্না, খেলার মাঠে নিজের প্রিয় দলের হয়ে সমর্থকদের গলা ফাটানো সমর্থন থেকে রাজনৈতিক নেতাদের ‘মানছি না-মানবো না’ স্লোগান সব কিছু এক সঙ্গে মেলে শহরের এই ঠিকানায়।
ইংরেজ আমলে ধর্মতলা ছিল ইংরেজ আর ফিরিঙ্গিদের বসতি। কারণ, অঞ্চলটি ছিল যেমন ফাঁকা তেমন পরিপাটি।দুপাশে গাছের সারির মাঝে মনোরম রাস্তা। তাই তৎকালীন বিলাসপ্রিয় ইংরেজদের কাছে জায়গাটি ছিল বিশেষ প্রিয়।
‘ধর্মতলা’ নামকরণ নিয়ে নানা মুনির নানা মত প্রচলিত আছে। কেউ বলেন ধর্ম্ম ঠাকুরের মন্দিরের কারণে এই জায়গার নাম ধর্মতলা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ধর্মতলার কাছে এস.এন. ব্যানার্জী রোডে একটি ধর্ম্ম ঠাকুরের মন্দির আজও বিরাজমান। দ্বিতীয় মত বলে, এক সময় কলকাতায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমাবেশ হতো এই জায়গায়। সেই বৌদ্ধদের “ধর্ম্মং শরণং গচ্ছামি” মিশে গেছে ‘ধর্মতলা’ নামের সঙ্গে। আবার কারো কারো মতে, ধর্মতলার টিপু সুলতান মসজিদের পাশেই ছিল মেসার্স কুক কোম্পানির আস্তাবল।ওই আস্তাবলের জমিতে ছিল আরও একটি মসজিদ। জনশ্রুতি, ওই মসজিদ ও তার সংলগ্ন দরগার জন্যই ‘ধর্মতলা’ নাম হয়েছে। কলকাতার প্রথম কা্রাবালার সমাবেশ হতো এই মসজিদ প্রাঙ্গণে।
ধর্মতলা নামকরণের কারণ যাই হোক না কেন, এই অঞ্চলের নাম শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে চারকোণে ক্লক টাওয়ার সহ সাদা গম্বুজাকৃতি বাড়ি, শহীদ মিনার, কার্জন পার্ক, এসপ্ল্যানেড মেট্রো স্টেশন, আর বাস স্ট্যান্ডে যাত্রীদের ব্যস্ততা, বিখ্যাত মোগলাই এর দোকান, রাজকীয় হোটেলের গাড়ি বারান্দা জুড়ে ভিড়ে ঠাসা বাজার, নিউ মার্কেট আর তার সংলগ্ন রাস্তাজুড়ে হরেক রকমের পুতুল, ইমিটেশন গয়নাগাটি প্রভৃতির পসরা আর আধুনিক যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন শপিং মল, চামড়ার জুতো, ব্যাগ, বেল্ট ইত্যাদির বিখ্যাত দোকান- এইরকম আরও কত টুকরো ছবি।
ওই যে সাদা গম্বুজাকৃতি বাড়িটা, তার ইতিহাস জানলে চমকে উঠতে হয়। বাড়িটার এখনকার নাম মেট্রোপলিটন বিল্ডিং।১৯০৫ সালে নিউ ব্যরক রীতিতে তৈরী এই বিল্ডিং টা ছিল সেই সময়ের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। তখন বাড়িটার নাম ছিল Whiteway Laidlaw department store । শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বাড়িটার বর্তমান মালিকানা ভারতীয় জীবনবিমা নিগমের হাতে।
এসপ্ল্যানেড বাসস্ট্যান্ডের গা ঘেঁষে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে অক্টারলোনি মনুমেন্ট। চিনতে অসুবিধা হলো? তাহলে শহীদ মিনার নামটির সঙ্গে আপনি নিশ্চয়ই পরিচিত। ব্রিটিশ মেজর জেনারেল স্যার ডেভিড অক্টারলোনির স্মৃতি রক্ষার্থে ১৮২৮ সালে ৪৮ মিটার উঁচু এই মনুমেন্ট তৈরী হয়। পরবর্তী কালে ১৯৬৯ খ্রীষ্টাব্দে শহীদ দিবসের দিন অর্থাৎ ৯ অগাষ্ট ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁদের স্মৃতি রক্ষার্থে এই মনুমেন্টের নাম বদল করে রাখা হয় শহীদ মিনার।
নেটিভ ভারতীয়দের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে যাতে বাজার করতে না হয়, সেই উদ্দেশ্যেই তৈরি হতে লাগলো নতুন একটি বাজার। ১৮৭৪ সালের পয়লা জানুয়ারি এই বাজার খুলে গেল সকল ব্রিটিশ আর বন্দরে আগত বিদেশি পর্যটক, ব্যবসায়ীদের জন্য। নতুন তৈরি হওয়া তৎকালীন বর্ণবিদ্বেষী এই বাজারটিই নিউ মার্কেট। তবে দু হাজার দোকান বিশিষ্ট এই বাজারে ব্যবসা করার অনুমতি ছিল ভারতীয়দের। ১৯০৩ সালের ২ ডিসেম্বর এই বাজারটির পোষাকি নাম হয় হগ মার্কেট।যদিও আজও নিউ মার্কেট নামটিই মানুষের মুখে মুখে বেশী প্রচলিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, স্টুয়ার্ট হগ ১৮৬৩ থেকে ১৮৭৭ সাল অবধি কলকাতা কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন। আরও জানা যায় এই মার্কেটের প্ল্যান করেছিলেন রিচার্ড রকসেল বেইন সাহেব। কাজটির জন্য সেই আমলে বেইন সাহেব হাজার টাকা পারিশ্রমিক লাভ করেন।
কলকাতা কর্পোরেশন ভবনের পাশেই জানবাজার আজও পরিচিত বাংলার এক মহীয়সী রাণী রাসমণির নামে। উদারপন্থী প্রজাদরদী রাণী রাসমণির বাড়ি কলকাতার এই জানবাজারেই। বাবু কালচারের উশৃঙ্খলতার যুগে রাণীর অভিভাবকত্বে এই পরিবার বজায় রেখেছিল সনাতনী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে। তাঁর উদ্যোগেই তৈরি হয় দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর মন্দির, যা ক্রমে ক্রমে হয়ে ওঠে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের লীলাভূমি। মা সারদা, স্বামী বিবেকানন্দ সহ আরও অনেক মহাপুরুষ ও মহীয়সীর স্মৃতি বিজড়িত এই মন্দির তৎকালীন সমাজকে দেখিয়েছিলো নব যুগের আলো।
ঐতিহ্য ও আধুনিকতার যুগলবন্দী সুর মুখরিত করে রাখে কলকাতা শহর কে। আর সেই শহরের হৃদপিন্ড বলা যায় ধর্মতলা অঞ্চলকে। তাই এই হৃদস্পন্দনের ছন্দ যে আসলে কলকাতাপ্রেমী সকলের মানুষের ছন্দ তা বলাই বাহুল্য।
নিবন্ধকারঃ প্রদীপ্তা কুন্ডু