পিঠে ঝোলা। পরণে ঢোলা প্যান্ট জামা। ছোট টানা চোখ। কলকাতার রাজপথে হেঁটে চলেছে পিঠে পসরা নিয়ে। এটুকু পড়ে কিছু মনে পড়লো? বুঝতে পারছেন নাতো, কার কথা বলছি! আরেকটু বলি, এরপর সে একটি গলিতে ঢোকে।
বাচ্চারা গোল হয়ে তাঁকে ঘিরে ধরে বলতে থাকে "চায়না ম্যান! চায়না ম্যান"! এবার নিশ্চয়ই বুঝেছেন? কি বললেন? এখনও বুঝতে পারছেন না, আমি কি বিষয়ে কথা বলছি! ১৯৫৯ সালে মুক্তি প্রাপ্ত ছবি "নীল আকাশের নিচে" ওয়াংলু চরিত্রের কথা বলছিলাম। এই চরিত্রে দেখা গিয়েছিল অভিনেতা কালী ব্যানার্জীকে আর ছবির পরিচালক ছিলেন মৃণাল সেন।
১৯৩০ সালের প্রেক্ষাপটে সিনেমার গল্পটি বোনা হয়েছিল। এক চায়না ম্যান সুদূর চিন দেশ থেকে কলকাতায় আসে। আর সঙ্গে করে আনে নিজের দেশের সিল্কের পোশাক। যা ঝোলায় ভরে পিঠে নিয়ে কলকাতার রাজপথে, অলিতে-গলিতে ফেরি করে বেড়ায়।
তবে চিনাদের কলকাতায় আসা শুরু হয়েছে আরও অনেক আগে। সময় ১৭৯৮ সাল। তখন কলকাতায় গভর্নর জেনারেল ছিলেন হেস্টিংস। এক চিনা ব্যবসায়ী কলকাতায় এলেন ব্যবসার উদ্দেশ্যে।
ব্যবসায়ীর নাম টং অছি। মনে করা হয় তিনি আধুনিক ভারতের প্রথম চিনা নাগরিক। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল হেস্টিংসের অনুমতিক্রমে একটি চিনির কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতা থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে হুগলি নদির ধারে বজবজের কাছে অছিপুরে গড়ে উঠে তাঁর চিনির কারখানা।
এরপর থেকে বড় সংখ্যায় চিনারা কলকাতায় আসা শুরু করে। ১৮৩৭ সালে কলকাতা পুলিশের রেকর্ড অনুসারে কলকাতায় চিনা নাগরিকের সংখ্যা ছিল ৩৬২ জন। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এমনকি ভারত স্বাধীনতার সময়ও সংখ্যাটা তো কমে নিই বরং বেড়েছিল।
লালবাজার বা সেন্ট্রাল কলকাতার কাছে টেরিটি বাজারে চিনারা বিপুল সংখ্যায় থাকত। তাঁরা মূলত ছুতারের কাজ করতেন। এখনও টেরিটি বাজারে সকালবেলা গেলে চিনা অথেন্টিক নাস্তা পাওয়া যায়। ইন্দো-চিন যুদ্ধ শুরু হয়।
কলকাতার চিনা নাগরিকরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। সেইসময় কলকাতার বাইরে ট্যাংরা ও তপসিয়া অঞ্চলে চিনারা থাকা শুরু করেন। এই এলাকা তখন জলাভূমি। তাঁদের প্রচেষ্টায় এই অঞ্চল বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।
চিনাদের একটি বিশেষ সম্প্রদায় হল হাক্কা। হাক্কা গোষ্ঠী চামড়া শিল্পে বিশেষ পারদর্শী। কলকাতায় বসবাসকারী চিনাদের মধ্যে হাক্কারাই সংখ্যায় বেশি ছিলেন। তাঁরা এখানে এসে শুরু করলেন চামড়ার ব্যবসা। গড়ে উঠলো ট্যানারি। শ্রমিক হিসেবেও নিযুক্ত হলেন চিনারাই।
একের পর এক কারখানা গড়ে উঠে ট্যাংরায়। তবে এমন নয় যে চায়না টাউনের পুরোটাই ছিল কারখানা। কিছু রেস্তোরাঁ তখনও ছিল। কিছু কিছু রেস্তোরাঁ রয়েছে যা দু'দশক ছুঁতে চলেছে। ট্যাংরায় কারখানাগুলো বহাল তবিয়তেই চলছিল।
কিন্তু তার প্রভাব পরিবেশের ওপর পড়তে শুরু করে। ১৯৮৭ সালে এক মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় কারখানাগুলোর জন্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ। সেই রায়ের পর এই অঞ্চলের কারখানাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়।
প্রচুর শ্রমিক আর্থিক সমস্যায় পড়েন। অনেকে চিনে ফিরে যান। যাঁরা এখানে থেকে যান তাঁরা কারখানাগুলোকে ধীরে ধীরে রেস্তোরাঁয় পরিণত করেন। ১৯৯০ সাল নাগাদ আনুমানিক ৩০টি চাইনিজ রেস্তোরাঁ ছিল মনে করা হয়।
যা চায়না টাউনের মূল আকর্ষণ। তবে অথেন্টিক চাইনিজ স্বাদ এখন আর পাওয়া যাবে না। তাতে মিশেছে ভারতীয় ঘরাণার স্বাদ। জন্ম নিয়েছে ইন্ডিয়ান চাইনিজ রেসিপি। বাঙালিদের চাহিদা অনুযায়ী খাবারে মশলা ও ঝালের পরিমাণ বহু মাত্রায় বেড়েছে।
তবে সসের ক্ষেত্রে এখনও চায়না টাউনের চিনারা অথেন্টিসিটি বজায় রেখেছেন। চাউমিন, চিলি চিকেন ছাড়াও পিকিং রোস্টেড ডাক, স্প্রিং রোল, ড্রাম প্লিসেংর মতো চিনা খাবার এখানে পাওয়া যায়।
তবে বর্তমানে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় চিনা খাবার পাওয়া যাওয়ায় এখানকার চাহিদা কিছুটা হলেও কমেছে। এই প্রজন্মের অনেকে আবার চায়না টাউন ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার জীবিকা পরিবর্তন করেছেন। তারপরও কলকাতার চায়না টাউনের একটা আলাদা আকর্ষণ রয়েছে। যার টানে আজও অনেকেই ভীড় জমায় এই চিনা পাড়ায়।