গতকাল শ্যামবাজার থেকে প্রায় গন্তব্যহীন ভাবেই উঠে পড়লাম এসপ্ল্যানেড-গামী ট্রামে। কী মনে হলো, বিশেষ তাড়া নেই। এই ট্রাম নাম সত্য হে-র যুগে খুব প্রয়োজনে আর কেউ ওঠেনা এ যানে। যে শহরে এখন গঙ্গার নীচ দিয়ে মেট্রো যাচ্ছে সেই শহরেই একদা বিভূতিভূষণের অপু সারাদিন ধরে একটা চাকরির খোঁজে শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে ঘুরেছে।
পড়ন্ত বিকেলে রাসবিহারী এভিনিউতে ট্রামলাইন বরাবর হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ট্রামের ক্যাচারে আটকে গেলেন একজন অন্যমনস্ক ভদ্রলোক। লোকজন ছুটে এল সঙ্গে সঙ্গে...
কী নাম?
কোথায় থাকেন আপনি?
রক্তাক্ত অবস্থায় বললেন, আমার নাম জীবনানন্দ দাশ। ওই ল্যান্সডাউন রোডে থাকি, ১৮৩ নম্বর বাড়ি। এই জীবনানন্দ-ই তো লিখেছিলেন, "কয়েকটি আদিম সর্পিনী সহোদরার মতো এই যে ট্রামের লাইন ছড়িয়ে আছে, পায়ের তলে, সমস্ত শরীরের রক্তে, এদের বিষাক্ত বিস্বাদ স্পর্শ অনুভব করে হাঁটছি আমি......" ট্রাম নিয়ে ট্রমা করতে পারেন কেবল জীবনানন্দ-ই।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় লিখতে পারেন, ভোরের ট্রামের মতো প্রেমের সঞ্চার, মানুষের দেহে মনে। সত্যিই তো! আর প্রেমের সঙ্গে ট্রামের একটা অদ্ভুত মৃদুমন্থর যোগসূত্র রয়েছে। এই যে ধীর চলন বা দুলুনিটার মধ্যে, খানিক দাঁড়ানো আবার চলা....আবার দাঁড়ানো...আবার চলা। ধিকি ধিকি একটা গতি বা প্রায় গতিহীন। যে প্রধান কারণবশত ট্রামকে শহরছাড়া হতে হলো। শহরকে গতিশীল করার প্রয়োজনে একটা দূষণহীন যানকে প্রায় উঠিয়ে দেওয়া হলো। অথচ মেলবোর্ন, আমস্টারডাম, লিসবন, বস্টন ইত্যাদি অনেক শহরে এখনও ট্রাম চলে। এই শহরগুলোর ব্যস্ততা কলকাতার থেকে কম নয়, বরং আরও বেশি।
জীবনের গতি অনেক বেড়েছে ঠিকই তবু এই ম্লান মুষড়ে পড়া বুড়ো বাহনটি জানে কলকাতা ভালোবাসার শহর। যে শহরকে মৃণাল সেন এলডোরাডো বলেছিলেন। কোনও কারণ আছে কী!
এই ঘিঞ্জি, নোংরা, ভাঙাচোড়া, মধ্যবিত্তের শহরই স্বপ্নের শহর, ভালোবাসার শহর অনেকের কাছে। তবু তো বসন্ত আসে, প্রেম আসে এই শহরে। ফুল নিয়ে কোনও যুবক বা যুবতী দাঁড়িয়ে আছে হেঁদুয়ার কাছে বা রাসবিহারীতে। বইপাড়া থেকে কোনও রোগা, শীর্ণ যুবক(মান্না দের ভাষায় যার কাঁধেতে ঝোলানো ব্যাগ) মেঘলা দুপুরে উঠে পড়ল একটা ফাঁকা ট্রামে। হাতে নিয়ে ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতার বই পড়ছে। "ওগো সকালবেলার ট্রাম, তোমার যাবার পথে দুদিকে গাছের সারি বসিয়ে রেখেছি। আমার আত্মাকে তুমি দেখো আজ।..."
প্রচুর বাংলা কবিতায়, গল্পে, চলচ্চিত্রে নিভৃতে, স্মৃতিতে থেকে যাবে বস্তুটি। চল রাস্তায় সাজি ট্রামলাইন___মার্কা আধুনিক নস্টালজিক কাব্যিক লিরিকে রয়ে যাবে তার রেশ।
ট্রাম পেরিয়ে যাচ্ছে হাতিবাগান, হেঁদুয়া, প্রেসিডেন্সি, কলেজস্ট্রিট, ওয়েলিংটন.....। ট্রাম পেরিয়ে যাচ্ছে গড়িয়াহাট, বেকবাগান, নোনাপুকুর....। ট্রাম পেরিয়ে যাচ্ছে আলগা স্মৃতির লাইন ধরে।
শহরের আকাশ কালো করে আসছে, মুষলধারে বৃষ্টি নামবে। বিকাশ ভট্টাচার্যর আঁকা ছবিতে দেখেছি ট্রামলাইনে একাকী একটা গরু বসে আছে। বৃষ্টিতে ভেজা ট্রামলাইন ধরে ঢং ঢং করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে আমার রঙচটা বুড়ো বাহন। এই সময়ের সঙ্গে আর খাপ খাওয়াতে পারে না নিজেকে সে। তার বৃদ্ধ শরীর জুড়ে চুঁইয়ে পড়ছে বৃষ্টির ধারা। যে জলে বোধ করি ঐতিহ্যের অশ্রুফোঁটাও মিশে আছে খানিকটা।
সাগ্নিক রায়
কলকাতা