ছোটবেলা থেকেই তাঁর ইচ্ছে ঠাকুর গড়া এবং কারিগরদের কাছে থাকা। তাঁদের কাজ দেখে মুগ্ধ হয়ে যেত সে। কীভাবে মাটির সঙ্গে বাঁশ ও খড় মিশিয়ে তৈরি করে ফেলছেন প্রতিমা, সব মন দিয়ে দেখে শেখার চেষ্টা ছিল। মনে মনে হয়তো নির্মাণ করে ফেলত দুর্গা-সরস্বতী-কালী মূর্তি।
তারপর সে শুরু করল মূর্তি গড়া। আজ সেই ছেলে ট্র্যাফিক পুলিশের চাকরি করে। তবে, সেই ইচ্ছে তিনি নিজের ইচ্ছেকে দমিয়ে দেয়নি। চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়সে চাকরি- ইচ্ছে দুটোকেই একসাথে সামলাচ্ছেন। তিনি সুকুমার মণ্ডল। কাজের চাপ থাকা সত্ত্বেও তৈরি করে বহু প্রতিমা।
এক সংবাদ মাধ্যমের দ্বারা সুকুমার জানান যে ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফেরার পথে ব্যাগ কাঁধেই ঢুকে পড়তো প্রতিমা তৈরির জায়গাগুলোয়। মন দিয়ে দেখতো কীভাবে কারিগররা প্রাণ দিচ্ছে মূর্তিগুলোয়। সেই দেখে নিজেও বাড়ি ফিরে মাটি দিয়ে নানা মূর্তি বানাতেন। ক্লাস সেভেনে যখন পড়তেন, সেই সময় পাড়ার ক্লাবের জন্য সরস্বতী প্রতিমা বানিয়েছিলেন, সকলের খুব পছন্দ হয়েছিল। পরের বছরেও কালী প্রতিমার ভার পড়ল তাঁর ওপরেই।
বাঁশদ্রোণীর রানিয়া উদয়ন পল্লিতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ছোট্ট সুকুমার। নিকটবর্তী তিরপুকুরের ‘বারো মাস তেরো পার্বণ’ পরিকল্পনার অংশীদার হিসেবে ডাক পড়ল মূর্তি গড়ার। তারপরেই এলাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ল নামডাক। আসতে লাগল অর্ডার। তখন সবে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন সুকুমার। পাড়ার ক্লাব থেকে জানানো হল, এবার পঞ্চদুর্গা তাঁকেই গড়তে হবে।
সুকুমার মণ্ডল এই বিষয়ে জানান, ”সেদিন আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন আমার গুরু। বাঁশদ্রোণীরই রাইফেল ক্লাবের রাজেশ সমাদ্দার। তিনিও ঠাকুর বানান। তাঁর কাছেই গিয়ে পড়লাম। তিনিই পাশে দাঁড়ালেন। তাছাড়া ভাই সুধাংশু তো আমাকে প্রথম থেকেই সাহায্য করত মূর্তি গড়ার কাজে। সেই ভরসাতেই এগিয়ে যাই। সেই থেকে উনিশ বছর হয়ে গেল, আমিই পাড়ার ক্লাবের দুর্গাপ্রতিমা বানাই। প্রতিবারই পঞ্চদুর্গা। সেই সঙ্গে আশপাশের আরও ক্লাবের অর্ডার। সব মিলিয়ে আট-দশটা কাজ। আরও গোটা দশেক অর্ডার নিতে পারিনি। কাজের চাপ সামলে এর বেশি পারি না।”
তিনি আরও জানিয়েছেন যে শুধু দুর্গা নয়, কালী প্রতিমাও গড়েন তিনি। ফাল্গুন-চৈত্র থেকে শুরু করে দেন কাজ। যত চাপ বাড়ে, বাড়ির লোকেরাও তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান। সুকুমারকে সাহায্য়ের হাত বাড়িয়ে দেন স্ত্রীও। পাশাপাশি বৃদ্ধ বাবাও যতটা পারেন করেন। বাদ নেই তাঁর পুত্রও, ক্লাস ফোরের ছোট্ট ছেলেটিও বাবার পাশে বসে সাহায্য করেন।
তিনি জানান যে যখন চাপ বাড়ে অর্থাৎ পুজো একেবারে সামনে সেই সময় মূলত ২টো থেকে ১১টার শিফটই দেওয়া হয় তাঁকে। মাঝে মাঝে অবশ্য মর্নিং কিংবা নাইট ডিউটিও পড়ে। দুপুরের শিফট সেরে বাড়ি এসে সারা রাত কাজ করে যেতে হয়। পুজোর সময় ছুটি থাকে না। টানা ডিউটি থাকে। সেই কারণে প্রাপ্য ছুটিগুলি জমিয়ে রেখে পরের বছর পুজোর আগে অবশ্য নিয়ে নেন। এই ভাবেই কাজ শেষ হয়।
পরিবারের অনটন সামলাতে প্রতিমা তৈরির পাশাপাশি টিউশনিও করতেন। কিন্তু বুঝতে পারছিলেন এভাবে চলবে না। তাই শুরু করেন চাকরির পরীক্ষা দেওয়া। অবশেষে ২০০৯ সালে পেয়ে যান সরকারি চাকরি। প্রথমে রিজার্ভ ফোর্স, পরে মেয়র অফিসে ডেপুটেশন। ২০১৮ সাল থেকে ট্র্যাফিক গার্ড।
সুকুমার নাকি কলকাতা ম্যারাথন রেসে এক ঘণ্টায় দশ কিলোমিটার অনায়াসে পেরিয়ে যান। দৌড় কিংবা ফায়ারিং, ড্রিল এসবেও তিনি একেবারে তৈরি।
সুকুমারের সনাতন রুদ্র পালের তৈরি প্রতিমা তাঁর সবচেয়ে বেশী প্রিয়। একবার দেখলে চোখ ফেরাতে পারা যায়না । স্বীকার করতে লজ্জা নেই, তাঁকেই অনুকরণ করতে চায় তিনি। স্বপ্ন দেখেন যে একদিন সেইরকম কাজ তিনিও করতে পারবেন।