গোটা পৃথিবীটা যদি একটা রঙ্গ মঞ্চ হয়, তবে সেই রঙ্গালয় বর্তমানে এক অন্ধকার সময়ের মধ্যে থেমে রয়েছে। যেনো একটা অন্ধকার মঞ্চ। আলো ছিল, কিন্তু এখন নেই। মানুষও আর একসঙ্গে নেই। থাকবে পারবেনা, অন্তত আসন্ন কিছু দিনের জন্য। মানব সভ্যতা সংকটের মুখাপেক্ষী আগেও বহুবার হয়েছে। মুখোমুখি হয়েছে মহামারিরও।
একুশ শতকের দ্বিতীয় দশক চলছে। আধুনিকতার দৌরাত্ম্য সর্বত্র। এর মাঝেই সকল চাকচিক্য, রাজনৈতিক হিংসা, ক্ষমতার লড়াই কে এক তুরিতে স্ট্যাচু বানিয়ে ফেললো অজানা ভাইরাস।সামাজিক মূল্যবোধের অভাব পূরণে নাটক অঙ্গীকারবদ্ধ। শুধু নাটক নয়, একই সঙ্গে অঙ্গীকারবদ্ধ একে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকা, নতুন সমাজের স্বপ্ন দেখা এক বিরাট নবকল্লোল।
পৃথিবীর গতি থামলেও, ফিরেছে প্রকৃতির নিজস্ব ছন্দ ও সুর। তাই থামেননি তাঁরাও। নাট্য পথিকরা। আজ বিশ্ব নাট্য দিবসে জেনে নেবো এরকমই কিছু নতুন অঙ্গীকারের কথা। তাঁরা এখনও স্বপ্ন দেখছেন। তিপ্পান্ন বছর ধরে চলমান এই নাটুকে ইতিহাস। শুরুটায় হয়তো একটু হুজুগ মিশে ছিল। ১৯৬১-তে এই দিনটার ভাবনা। হেলসিঙ্কি ও পরে ভিয়েনাতে অনুষ্ঠিত আইটিআই-এর নবম বিশ্ব কংগ্রেসে ফিনল্যান্ডের রাষ্ট্রীয় আইটিআই সারা বিশ্বের নাট্যকর্মীদের সৌভ্রাতৃত্ব আর ভাবনার আদানপ্রদানের লক্ষ্যে একটা দিনকে নির্দিষ্ট করার অনুরোধ জানায় আন্তর্জাতিক আইটিআই, ইউনেসকোকে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো একযোগে প্রস্তাবটিকে সমর্থন করে। পরের বছর ১৯৬২-তে প্যারিসে ‘থিয়েটার নেশন্স’ নাট্যোৎসব শুরু হয় এই ২৭ মার্চ থেকে। ইউনেসকো বলে দেয়, এই দিনটাই হোক বিশ্ব নাট্য দিবস।
মিঠুন গুপ্ত। বছর ২৪। কলকাতা বিশ্বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র। থিয়েটার ওর স্বপ্নে আসে। মাধ্যমিক ডিঙিয়েই শুরু। জানাচ্ছেন, " ২১ দিনের অনটনে অনেকেই ভুগছেন। কিন্তু আমি এই বন্দী দশাতেও খুঁজে নিয়েছি থিয়েটার কে। আগামী কাজগুলো নিয়ে ধোঁয়া উঁচিয়ে প্রাকটিস চলছে। সব মেপে নিচ্ছি, হ্যাঁ মেপে নিচ্ছি কারণ আমি নির্দেশকের অভিনেতা। চলছে ঘরকন্যার কাজে মা কে সাহায্যও। বর্তমানে আমি কথাকৃতি, উত্তরপাড়া ব্রত্যজন, নৈহাটি বিহঙ্গ দলগুলির সঙ্গে নিয়মিত কাজে ব্যস্ত। হ্যাঁ, কথাকৃতি তে আমার প্রাণটা আছে। সম্প্রতি বালিতেও একটা দলের সঙ্গে কথা হয়েছে। আজ আমিও নাটকের মধ্যেই থাকবো ভেবেছি। দুপুরে গ্রুপ ভিডিও কলে যে যার পার্ট বলবো।এই এসবের জন্যে...আমি আশাবাদী আমরা এই সময় কে খুব তাড়াতাড়িই বিদায় জানাবো। "
ওই কথাকৃতি দলেরই ধারক ও বাহকের গলায় আবার হালকা নিরাশার খচ খচানি। সঞ্জীব রায়। নামটা শুনলেই যে গুণীজনেরা এখনও কথায় হারিয়ে যান, তাঁরা জানেন কথাকৃতির হৃৎস্পন্দন তিনি। কিছুদিন আগে ন্যাশনাল স্কুল অফ্ ড্রামার উদ্যোগে ভারত রঙ মহোৎসবে নাটক নিয়ে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আবার ফিরতেই ডাক এসেছিল সেই জগতের। না, শেষের কথাটি ওনারই স্বদক্তি।বললেন, " আমি কিছুটা নিরাশ হচ্ছিই এই আসে পাশের অবস্থায়। অনেক কাজই তো বাকি রয়ে গেলো। আমার সহধর্মিনীও প্রায় শয্যাশায়ী। এমত অবস্থায় নাটক আঁকড়েই চলছি। আর এখন তো সেটাও বন্ধ। আমি শুভেচ্ছা, ভালোবাসা আর প্রণাম সকলকেই জানাবো। আবার প্রশ্নও করবো কী করছি আমরা? আর কতদিন এইভাবে "?
এভাবে নাটক নিয়েই দর্ষণ রচনা করছেন আরও যাঁরা, বিভাস চক্রবর্তী, কৌশিক চট্টোপাধ্যায়, কিঞ্জল নন্দ, শুভদীপ গুহ, সৌপ্তিক, এনাদের নাট্য যাপন শুনতে হলে যেতে হবে জিও বাংলার ইউটিউব এবং ফেসবুক পেজে। তাহলে একজন আশবাদী। আর একজন নন। দেখার বিষয়, একটা না একটা স্বপ্ন কিন্তু দুজনেই দেখছেন। আর সেটাই হয়ত সমস্ত মানবজাতির আগামী ইতিহাস দেখছে।
পৃথিবীর মানচিত্র আঁকছিলেন একজন। এখনও এঁকে চলেছেন। সেখানে একটু হাওয়া লেগে আঁকার জিনিস গুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। জায়গাটা দুলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাওয়া থামবে নিশ্চয়। সকলকে আন্তর্জাতিক নাট্য দিবসের আগুন ভালোবাসা উপহার রইলো।