স্বাদে-স্মৃতিতে অতুলনীয়

সেদিন এক কাজেই বেরিয়েছিলাম উত্তর কলকাতার দিকে আজকাল ব্যস্ততার ফাঁদে পড়ে 'ঘুরে বেড়ানো', 'হাঁটাহাঁটি' -এরা বড্ড কাঁদে। সেদিন কাজেই বেরিয়েছিলাম কিন্তু ব্যস্ততা ছিলনা। প্রকৃতির তেজ সঙ্গে ভোটবাজার,  অসহনীয় পরিস্থিতির রসায়নে 'এ.সি' হীন মানুষ নিজেদেরকে কীভাবে সন্তুষ্ট করবে বুঝে উঠতে হিমসিম খাচ্ছে। সেদিন সকাল থেকেই আবহাওয়া দপ্তরের মুখে একটাই কথা 'বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টি'। একটানা প্রখর গরমের পর বৃষ্টি হলে তা খুব একটা কাকতালীয় ঘটনা হবে না বলেই বিশ্বাস করেছিলাম আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস। বিকেলের পর সত্যিই মিলে গেল, বিকেল বেলাতেই মনে হল গোধূলি নেমেছে। এমন একটা প্রসন্ন আবহাওয়া তৈরী হয়েছিল মনে হচ্ছিল গোটা শহর জুড়ানোর জন্য বিধাতা ঠান্ডা হওয়ার মেশিন বসিয়েছেন। রাস্তার ওপর প্লাস্টিক পেতে শুয়ে থাকা এক মা তার বছর দু'য়েকের ছোট্ট ছেলেটাকে চুমু খেতে খেতে পাশের প্লাস্টিকে ঘুমন্তরত একটি লোককে বলল 'আঃ...আমার চাঁদ'টা এতক্ষণ পর শান্তিতে একটু ঘুমালো,  রাত থেকে মোটে ঘুমাতে চাচ্ছিল না ছেলেটা, রাস্তা তেতে আগুন, একটু শু'লেই পিঠ পুড়ে যাওয়ার জোগাড়... কী ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে, ঠাকুর একটু বৃষ্টি দাও...'। এইসমস্ত পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে মনে মনে বললাম, এরকম আবহাওয়া নতুন নয়, নিশ্চয়ই কোথাও বেশ ভালোরকম বৃষ্টি নেমেছে। এমন আবহাওয়া যে, মানুষদের মুখগুলোতে ক্লান্তি টের পাওয়া যাচ্ছিল না, সকলের চোখে-মুখে বৃষ্টি আসার আগাম আনন্দ। মন টা ভাল হয়ে গেল। যাওয়ার কথা ছিল শ্যামবাজার থেকে কলেজস্ট্রিট, ভেবেছিলাম দু'পা হেঁটে বাস বা ট্রাম-এ উঠে পড়ব। কিন্তু কাজের মধ্যে ব্যস্ততা না থাকায় আর এইসব আবহাওয়ায় কখন যে হাঁটতে হাঁটতে হেদুয়ার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি খেয়াল করিনি। 

খেয়াল হল বিধানসরণীর উপর একটি চপের দোকানে 'চোখে লাগা' ভিড় আর সেই দোকানে নেতাজির বড় বড় ছবি দেখে। জানার কৌতুহল আর গরম গরম চপের লোভ -দুইই সামলানো দায় আমার পক্ষে। ভিড় ঠেলে চোখ বোলাতে শুরু করলাম বাহারি চপের বড় বড় করে লেখা ডিজিটাল মেনু লিস্টে। সোয়াবিনের চপ, চাউমিন চপ, আমের চপ, আলুর চপ, বেগুনী, পিঁয়াজি, ফুলুরি, পনিরের চপ, নারকেলের চপ, ফুলকপির চপ, ভেজ কাটলেট, পনির কাটলেট, সোয়াবিন কাটলেট -এসব সম্মোহনী স্বাদের তালিকা দেখে ঘাবড়ে গিয়ে অর্ডার করলাম একটা আলুর চপ, একটা আমের চপ আর একটা পনির কাটলেট। কিছুক্ষণ পরই হাতে এসে পৌঁছাল গরম গরম সুগন্ধী চপের ঠোঙা। চপে কামড় দিয়ে বুঝলাম এ যে সে চপ নয়! আগেই বলেছি দোকানটিতে নেতাজির বড় বড় ছবি দেখেছিলাম এবার আবিষ্কার করলাম দোকানের সামনেই নেতাজীর আবক্ষ মূর্তি, শুধু তাই নয় এই দোকানের কথা বিভিন্ন সংবাদপত্রেও বেরিয়েছে, এই দোকানে খেয়েছেন বহু কেউকেটা মানুষ এবং সেসবের কাটাউটও ডিজিট্যাল প্রিন্ট করে রাখা হয়েছে। এসব দেখে-পড়ে যা বুঝলাম- এই দোকানের কেউকেটা খরিদ্দারদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুভাষ চন্দ্র বসু অর্থাৎ 'নেতাজি'। কলকাতার বহু প্রাচীন, ঐতিহ্যময় এই তেলেভাজার দোকান; একশ' বছর পুরনো। ১৯১৮ সালে একটি ছোট্ট গুমটি তেলেভাজার দোকান খোলেন খেদু ওরফে লক্ষ্মী রতন সাউ নামের এক ব্যক্তি। নাম দেন 'লক্ষ্মী নারায়ণ সাউ অ্যান্ড সন্স' স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াকালীন সুভাষ বসু এই দোকান থেকেই তেলেভাজা খেতেন। এমনকি ১৯৪০-৪২-এর সময় যখন দেশকে স্বাধীন করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন কতশত বিপ্লবী-মহাপ্রান ব্যাক্তিরা, সেইসব সময় শ্যামবাজার-কাশীপুর অঞ্চলে কোনও গুপ্ত বৈঠক হলে, এই দোকান থেকেই যেত তেলেভাজা। তেলেভাজা, মুড়ি, ধোঁয়া ওঠা চায়ের সঙ্গে জমে উঠত ইংরেজ হঠানোর ব্লু প্রিন্ট। নেতাজির আদর্শে উদজ্জীবিত হয়ে ১৯৪২ সাল থেকে প্রতিবছর ২৩ জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিন উপলক্ষে বিনা পয়সায় তেলেভাজা বিলোতে শুরু করেন দোকানের প্রতিষ্ঠাতা খেদু ওরফে লক্ষ্মী নারায়ণ সাউ, যে রেওয়াজ এখনও চলছে এবং আগামীতেও চলবে এমনটাই জানিয়েছেন তাঁর বর্তমান উত্তরসূরিরা। 

 কলকাতার সঙ্গে জন্ম থেকে ওঠা-বসা-থাকা-খাওয়া থাকলেও আমি জন্মসূত্রে কলকাতানিবাসী নই, তা নিয়ে অবশ্য আমার কোনও মাথাব্যথাও নেই কারণ ভালবাসা-আগ্রহ-অনুভূতির শিকড় তো একটাই, ঠিকানা-জীবন-মানুষ এসব তো পরিবর্তন হতেই থাকে। তবে যাঁরা কলকাতার অলিগলি চেনেন এবং আদি কলকাতানিবাসী তাঁরা এই দোকানকে এক বাক্যে চিনে নেন 'নেতাজির চপের দোকান' হিসেবে। ১৯৪৮ সালে সেই ছোট্ট গুমটি দোকান ভেঙে সাজিয়ে গুছিয়ে বেশ কিছুটা রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন খেদু সাউ। সেই খেদু সাউও আর নেই, নেই 'নেতাজি'ও; শুধু এখনও রমরম করে রয়ে গিয়েছে তাঁদের স্মৃতিবিজড়িত 'লক্ষ্মী নারায়ণ সাউ অ্যান্ড সন্স' ওরফে 'নেতাজির চপের দোকান' । সস্ত্বির বৃষ্টি, স্বাদ আর স্মৃতিমেদুরতায় কাক-ভিজে কলেজ স্ট্রিট পোঁছেছিলাম সেদিন।

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...