জলের অপর নাম যেমন জীবন, তেমনই গাছের অপর নামও জীবন। এই দুই ছাড়া বেঁচে থাকা দুষ্কর। যানবাহনের সংখ্যা দিনের পর দিন বেড়ে চলায় ও নিত্যনতুন কলকারখানা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায়, এমনিতেই কলকাতা সহ অন্যান্য নগরাঞ্চলগুলিতে দূষণের মাত্রা ক্রমবর্দ্ধমান। তবে এবার উদ্ভিদের বিকাশের পথে নতুন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কংক্রিটের বেদীগুলি। পথসংলগ্ন গাছগুলির গোড়ায় বেদী স্থাপন করার ফলে গাছগুলি পর্যাপ্ত পুষ্টি গ্রহণ করতে পারছে না। গাছের মূলগুলি যাতে সহজেই মাটির গভীর পর্যন্ত পৌঁছে প্রয়োজনীয় জল শোষণ করতে পারে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে মাটি ও বাতাসের সংস্পর্শে থাকতে পারে, সেই ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করতে শুক্রবার গাছগুলিকে কংক্রিট মুক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টের পক্ষ থেকে।
নাগরিক উন্নয়নের স্বার্থে ও কাঠ মাফিয়াদের অবারিত কৃচ্ছসাধনের দরুন প্রচুর গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। সম্প্রতি যশোর রোডের গাছ কাটা নিয়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বৃহৎ পরিসরের আন্দোলন সূচিত হয়েছে। ডিভিশন বেঞ্চ-এর প্রধান বিচারপতির টিবিএন রাধাকৃষ্ণন ও হাইকোর্টের বিচারপতি অরিজিত ব্যানার্জির পক্ষ থেকে কলকাতা পৌরসভাকে অগাস্টের মধ্যে, এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পেশ করতে বলা হয়েছে।
বেশ কিছু কর্পোরেট সংস্থা তাদের নিজস্ব স্বার্থে এই কংক্রিটাইজেশন পদ্ধতির উপর অর্থ ব্যয় করছেন এবং বিজ্ঞাপনের জন্য তাদের কোম্পানির লোগো সেখানে ব্যবহার করছেন। ফলে পথচারীদের আশ্রয় দেওয়ার বদলে বিজ্ঞাপন ধারকের কাজ করছে গাছগুলি। এ বিষয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ডিভিশন বেঞ্চ।
জুনের মাঝামাঝি, দিল্লীতে, ফুটপাত সংলগ্ন গাছগুলিকে কেন্দ্র করে বেদী নির্মাণের বিরূদ্ধে একটি বিল পাশ করিয়েছে ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল।
পাবলিক (পিপল ইউনাইটেড ফর বেটার লিভিং ইন ক্যালকাটা) নামক একটি এনভায়রনমেন্ট-অ্যাক্টিভিস্ট দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা প্রদীপ কক্কর, শহরের রাস্তার গাছগুলিকে কংক্রিট ও টাইলস মুক্ত করতে ২৪শে মে একটি লিখিত পিটিশন দায়ের করেছিলেন। আগামী দিনেও যাতে এই সিদ্ধান্ত বহাল থাকে, সে বিষয়েও বিশেষ আর্জি জানিয়েছেন তিনি। এ ব্যাপারে আধিকারিকদের আরও সচেতন করতে আর্বান গ্রিনিং গাইডলাইন্স, ২০১৪-এর নিয়মগুলি পালন করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
আর্বান গ্রিনিং গাইডলাইন্স-এর কিছু নিয়মাবলী
- গাছ কেন্দ্র করে এমন কোনো কিছু নির্মাণ করা যাবে না, যা তাদের পূর্ণবিকাশের পথে বাঁধা সৃষ্টি করে।
- কিছু নির্মাণ করার পূর্বে মূলের বিকাশের জন্য যথাযথ পরিসর সুনিশ্চিত করতে হবে।
- বৃষ্টির জল প্রবেশের জন্য গাছগুলির চারপাশে পর্যাপ্ত স্থান ফাঁকা রাখতে হবে।
গত কয়েক বছর ধরে অবাধে চলছিল বেদী নির্মাণের কাজ। আর এ বছর গ্রীষ্মে তা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রাসেল স্ট্রীট, হো চি মিন সরণী, মিডলটন স্ট্রীট, জওহরলাল নেহেরু রোড, রাসবিহারী অ্যাভিন্যু, সার্দান অ্যাভিন্যু, বালিগঞ্জ সার্ক্যুলার রোড সহ নগরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলিতে, গাছগুলিকে কেন্দ্র করে বৃহৎ সংখ্যক বেদী প্রস্তুত করা হয়েছে, যা ক্রমেই তাদের মৃত্যুমুখে পতিত করছে। সঠিকভাবে মাটির গভীর পর্যন্ত মূল না পৌঁছনোর ফলে গাছগুলির বিকাশ সম্পন্ন হচ্ছে না, প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাচ্ছে না গাছগুলি। বর্তমানে কলকাতার রাস্তাগুলিতে খুব স্বল্প সংখ্যক গাছই অবশিষ্ট আছে, যেগুলি পূর্ণবিকাশের ক্ষেত্রে যথাযথ পুষ্টি পায়।
এ বিষয়ে আইনজীবি ঋতুপর্ণা চ্যাটার্জী, যিনি দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ সংক্রান্ত কেসগুলি লড়ছেন, জানিয়েছেন, “কংক্রিটের বেদীগুলি কেবল উদ্ভিদের ক্ষতিসাধনই করছে না, পথচারীদের সুরক্ষার ক্ষেত্রেও ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। একবার গাছের গোড়ায় বেদী নির্মাণ হলে হকারদের পাশাপাশি মানুষেরা সেখানে চায়ের দোকান সহ বিভিন্ন দোকান খুলে বসেন। ফলে পথচারীদের বড় রাস্তা দিয়ে হাঁটতে বাধ্য করা হয়-যা অনেক সময় তাদের দুর্ঘটনার দিকে নিয়ে যায়।“
গাছের মূল-কে কেন্দ্র করে যে কোনও প্রকারের বেদী নির্মাণ, উদ্ভিদের স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকারক। গাছের গোড়ায় সিমেন্টের বেদী নির্মাণ করে মন্দির স্থাপনের ঘটনাও এ দেশে বিরল নয়। তবে এর পরিণতি সম্বন্ধে মানুষ এখনও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নয়, সেখানে তাদের সচেতন করে তুলতে সমাজের সকল স্তরের সচেতন মানুষদের এগিয়ে আসা উচিৎ। তাদের বোঝানো উচিত, এভাবে ঈশ্বর উপাসনার ফলে গাছের ক্ষতি হচ্ছে। ঈশ্বর রয়েছেন সর্বভূতে । সুতরাং কে বলতে পারে এই মহীরূহ সমান বৃক্ষগুলিতে ঈশ্বরের উপস্থিতি নেই?