ক্যান্সার এক মারণ রোগ। এই রোগের কবলে পড়া মানুষজন শারীরিকভাবে যতটা না দুর্বল হয়ে পড়ে তার থেকে মানসিক দুর্বলতা তাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রে জীবনের রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। ক্যান্সারের কড়া ডোজের কেমোথেরাপি, ওষুধ আর রেডিয়েশনের জ্বালায় জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে তাদের। তারপর রয়েছে ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া। কেমোথেরাপির পর চুল উঠে যাওয়াটাই দস্তুর। আর এই চুল উঠে যাওয়াটাকেই মেনে নিতে কষ্ট হয় ক্যান্সার আক্রান্ত সেই ব্যক্তিদের। একদিকে মৃত্যুর অমোঘ ডাক যে ডাককে অস্বীকার করা যায় না তার উপর চুল উঠে সৌন্দর্য্যের বিনাশ, এই দুইয়ের মিলিত আক্রমণে নাজেহাল অবস্থা হয় সেই মানুষটির। কাজকর্মে বাধা তো আসতেই থাকে। একদিকে শরীরের কথা ভেবে অনেকেই এই সময় কাজ থেকে বিরতি নিয়ে থাকেন। কিন্তু অনেকে আছেন যারা সবে ক্যান্সারের আক্রমণকে প্রতিহত করে ফিরেছেন তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চান কাজে ফিরতে। কিন্তু চেহারার এইরকম অবস্থা নিয়ে অনেকেই কাজে বেরোতে সংকোচ বোধ করে থাকেন। অনেকে এই লজ্জা ঢাকার জন্য পরচুলাও ব্যবহার করে থাকেন। তাদের জন্যই এক অভিনব পন্থা গ্রহণ করেছেন কলকাতারই এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।
রবিবার কলকাতার ময়দানের রেঞ্জার্স গ্রাউন্ডে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা 'হেয়ার ফর হোপ ইন্ডিয়া' এক অভিনব অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। এই অনুষ্ঠানের মূলমন্ত্র ছিল ক্যান্সার আক্রান্তদের জন্য ১২ ইঞ্চি করে চুলদান।সেই সংস্থার ডাকে সাড়া দিয়ে চুল দেন স্কুল পড়ুয়া থেকে শুরু করে কলেজ পড়ুয়া এমনকি একজন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীও। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে চুল দান করেন একজন চিকিৎসকও। এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অভিনেতা ও মডেল মিলিন্দ সোমান| তার কাঁধেই দায়িত্ব ছিল দাতাদের চুল কাটার।
কলকাতার বুকে গড়ে তোলা এই অভিনব প্রয়াসে সাড়া দিয়ে রীতিমতো জনপ্রিয় কাব্য জৈন। কালকের এই অনুষ্ঠানের দাতাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ দাতা হিসেবে নিজের জায়গা পাকা করেছে এই খুদে। মাত্র কয়েকদিন আগেই সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই চুলদানের অভিনব প্রচেষ্টার কথা জানতে পারেন কাব্য-র মা প্রিয়াঙ্কা জৈন, যিনি পেশায় একজন ফ্যাশন ডিজাইনার। তিনি তার পেশার খাতিরে নানা নিয়মে বাঁধা। তাই তিনি তার সাত বছরের কন্যাকে জিজ্ঞেস করেন, সে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের যাদের মাথায় চুল নেই তাদের জন্য চুল দিতে চায় কিনা। শুনেই রাজি হয়ে যায় একরত্তি মেয়ে। এই দৃঢ়তার জন্য যত না প্রশংসা পাচ্ছে মেয়ে তার থেকে বেশি গর্বিত তার মা প্রিয়াঙ্কা।
সংবাদমাধ্যমের থেকে এই খবর জানতে পেরে এই অভিনব প্রয়াসে অংশগ্রহণ করেন চন্দননগর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী দীপান্বিতা। তার মা পূর্ণিমাদেবী মেয়ের চুল মেপে দেখেন ১২ ইঞ্চির অনেক বেশি চুল আছে তার মেয়ের মাথায়। আর মেয়েও আবদার জানায় যে, সেও চুল দিতে চায়। মেয়ের কথায় রাজি হয়ে যায় মা। নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব পেরিয়ে শেষমেশ চুল দান করেই ফেলেন মা-মেয়ের এই জুটি। কেশদানের এই অভিনব প্রচেষ্টাকে সফল করে তুলতে সেই মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন চিকিৎসক আরুণি গর্গ। শাশুড়ি মাকে ক্যান্সারের তীব্র জ্বালায় কষ্ট পেতে দেখে সেইদিনই তিনি ঠিক করে নিয়েছিলেন এইরকম একটি মঞ্চের আয়োজন যদি কোনোদিন কোথাও হয় তাহলে সেখানে গিয়ে তিনি তার চুল দান করে আসবেন। সেই আশাতেই চুল বাড়াতে শুরু করেন আরুণি। অনেকদিন বাদে এমন একটি মঞ্চ পেয়ে তিনি আপ্লুত, জানালেন তিনি নিজেই। অন্যদিকে, সেই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সিইও জানান, মোট ১১টি রাজ্যে ঘোরার পর কলকাতায় এসে এই শিবিরের আয়োজন করেন তারা। একেবারে অন্যরকমের অভিজ্ঞতা হয়েছে বলেও জানান তিনি।