সিনাগগ, ইহুদিদের উপাসনালয়

বহু ধর্মের মিলনক্ষেত্র আমাদের কলকাতায় এক সময় কাতারে কাতারে ইহুদিরা এসে
ভিড় জমিয়ে ছিল। সেই ইহুদিরের উপাসনালয়ের কথাই আজ বলব, কলকাতায় চলতে চলতে টকটকে লাল তিনকোণা মিনারের উপর কখনও দৃষ্টি পড়ে, সে জিনিসই সিনাগগ। তবে তার আগে খানিক কলকাতায় ইহুদিদের কথা। এ শহরে ইহুদিদের ঐতিহ্যের ইতিহাস বহন করছে এজরা স্ট্রিট। ব্রিটিশ আমলে কলকাতা যখন বাণিজ্যনগরী হিসেবে দেশের মধ্যে অন্যতম, ঠিক সেই সময় বাগদাদি ইহুদিরা এ দেশে আসেন। জনশ্রুতি রয়েছে ১৭৯৮ সালে সিরিয়ার আলেপ্পা থেকে শালোম ওয়াদিয়া কোহেন নামে এক ইহুদি ব্যবসায়ী বোম্বে, সুরাট হয়ে কলকাতায় পা রাখেন। তিনি প্রথমে অলংকারের ব্যবসা শুরু করলেও, পরে ধীরে ধীরে রেশমের কারবারে চলে আসেন এবং ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে কোহেনের ব্যবসা। ১৮৩১ সালে তার নামে নেভেহ শালোম গড়ে ওঠে। এদেশে তার আগমনের হেতু ছিল রাজাদেশ বা খানিক আমন্ত্রণ গোত্রীয় ভাবতেই পারেন। শোনা যায় পাঞ্জাবের দিলীপ সিংয়ের আহ্বানে কোহিনূর যাচাই করার জন্য ভারতে এসেছিলেন শালোম কোহেন। প্রথম আগমন এইভাবে হলেও এরপর থেকে নিজেদের প্রয়োজনেই ইহুদিরা পাড়ি জমাতে শুরু করে। তখন ভারতের প্রাণকেন্দ্র কলকাতা, স্বভাবতই ইহুদিদের কলকাতায় আসতেই হত। তারাও এসেওছে, থেকেওছে! কেউ কেউ ফিরে গিয়েছেন, আবার কেউ কেউ নারকেলডাঙার প্রধান সড়কের পাশে অবস্থিত ইহুদি সমাধিতে চিরনিদ্রায় সমাহিত হয়ে আছেন।

FotoJet (17)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়তেও বহু ইহুদি ছিলেন কলকাতায়।
স্বাধীন ভারতের প্রথম 'মিস ইন্ডিয়া' হয়েছিলেন এসথার ভিক্টোরিয়া আব্রাহাম
ওরফে প্রমীলা, আদপে তিনি একজন ইহুদি। ১৯৬৭-তে তাঁর মেয়েও 'মিস ইন্ডিয়া'
হয়েছিলেন। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই কালে কালে এ শহরে ইহুদিদের আনাগোনা কমতে শুরু করল। মূলত ইরাক থেকে আগত ইহুদীরাই কলকাতায় এসে ব্যবসা ও বসবাস শুরু করেছিল।

১৯৪৮-এ ইজরায়েল পুনরুদ্ধারের পরে ইহুদীরা নিজেদের দেশে ফিরতে
শুরু করেন। সেকালের কলকাতার তুলনায় আজ প্রায় নেই বললেই চলে, তবে তাদের কেক কিন্তু আজও আমাদের রসনা তৃপ্তি ঘটাচ্ছে। ক্রিসমাসে নাহুমস-এ যান তো?
শতাব্দী প্রাচীন কলকাতার এই কেকপীঠ ইহুদিদের দান।

হাওড়া ব্রিজ থেকে নেমেই পড়বে ব্র্যাবোর্ন রোড, তার পাশাপাশি চলেছে রবীন্দ্র
সরণি। দুই রাস্তার মাঝখানে বাম দিক বরাবর ঢুকে গিয়েছে একটি রাস্তা। ওটাই
এজরা স্ট্রিট। আগে এলাকার নামছিল ডোমটুলি। ডোমটুলি থেকে এজরা স্ট্রিট হয়ে
ওঠার যাত্রাই মহানগরের ইহুদিয়ানার সাক্ষ্য বহন করে। ডেভিড জোসেফ এজরা এবং
এলিয়া এজরার, এই বাপব্যাটার নামেই রাস্তার নামকরণ হয়েছে। কলকাতায় ইহুদি
গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে এই দুই এজারা অবদান অনস্বীকার্য। সেকেলে
কলকাতার সবচেয়ে প্রভাবশালী এই এজরা পরিবার ছিল রিয়েল এস্টেট কোম্পানি
'ফাদার-সন রিয়েল এস্টেট ম্যাগাজিন'- মালিক। মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে এজরা
হাউস, এসপ্ল্যানেড ম্যানসন, নেভে শালোম এই কোম্পানির হাতেই তৈরি। এই
চত্বরের আরেক বিখ্যাত ফ্যামিলি হল গাব্বে পরিবার। আলিপুর চিড়িয়াখানায়
গাব্বে হাউস যাদেরই অবদান।

আজকের এজরা স্ট্রিট হল আলোর অমরাবতী। প্রায় তিনশোর বেশি ইলেকট্রিক
সরঞ্জামের দোকান রয়েছে তিলোত্তমার এই মহল্লায়। তবে বিংশ শতকের অনেক আগে
থেকেই এই এলাকা আলোর মুখ দেখে ফেলেছে, এখানেই প্রথম বাংলা নাট্যমঞ্চ
নির্মাণ করেছিল রুশ লেবেদেফ সাহেব। আজও তার স্মৃতিতে এখানে একটি ফলক
বিরাজমান, 'ইন মেমোরি অফ গেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেদেফ।'
এ দেশের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে ১৭৮৫ সালে গেরাসিম
স্তেপানোভিচ লেবেদেফ ভারতে আসেন। প্রথমে মাদ্রাজে এবং পরে চলে এলেন
কলকাতায়। মাদ্রাজ থেকে তামিল, তারপর সংস্কৃত আয়ত্ত করার পরে সাহেবের বাংলা
শেখার ইচ্ছে হল। পাকড়াও করলেন জনৈক স্কুল শিক্ষক গোলোকনাথ দাসকে, লেবেদেফ ছিলেন যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পী। গোলোকনাথের সঙ্গে ডিল হল, তিনি শেখাবেন পশ্চাত্য সঙ্গীত আর বেহালা। বিনিময়ে বাংলা শিখে নেবেন। তবে বাঙালি আরও এক কাজের জন্য সাহেবের কাছে কৃতজ্ঞ।

১৭৯৫ সালে গেরাসিম স্তেপানোভিচ লেবেদেফ ৩৭-৩৯ এজরা স্ট্রিটে প্রথম বাংলা
প্রসেনিয়ম থিয়েটার 'দি বেঙ্গলি থিয়েটার' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর আগে
কলকাতায় ইংরেজদের প্রতিষ্ঠিত দুটি নাট্যমঞ্চ ছিল সেখানে কেবল ইংরেজি নাটকই
অভিনীত হত। ঐ বছর ২৭শে নভেম্বর কাল্পনিক সংবদল নামক একটি বাংলা অনুবাদ-নাটক মঞ্চস্থ করলেন লেবেদেফ সাহেব। বাংলায় থিয়েটার কালচারের জন্ম দিলেন লেবেদেফ সাহেব, তাঁর সাফল্যে উৎসাহিত কলকাতায় হিন্দু থিয়েটার, জোড়াসাঁকো নাট্যশালা, বিদ্যোৎসাহিনী মঞ্চ ইত্যাদি; একের পর এক নাট্যমঞ্চ তৈরি হয়ে গেল। লেবেদেফের নাট্যশালায় নারী-পুরুষ উভয়ই অভিনয় করত যা সেযুগে রীতিমতো বিল্পব ঘটিয়েছিল। অভিনয় এই ইহুদি পাড়ায় মিশে গিয়েছিল, নির্বাক চলচ্চিত্র যুগের প্রখ্যাত অভিনেত্রী আরতী দেবীও ইহুদি। তার আসল নাম ছিল রাচেল
সোফাইয়ার।

এবার আসি আসল কথায়, তবে ইহুদিদের সংখ্যা কমে গেলেও তাদের উপাসনালয় আজও দাঁড়িয়ে আছে কলকাতায়। তাদের উপাসনালয়ের নাম সিনাগগ, এককালে কলকাতার বুকে পাঁচটি সিনাগগ তৈরি হয়েছিল, নেভে শ্যালোম সিনাগগ, মাগেন ডেভিড সিনাগগ, বেথ এল সিনাগগ, মাগেন এবথ এন্ড ইসিবিথ জেকব বেঞ্জামিন ইলিয়াস প্রেয়ার হল, এবং শ্যারে রেশন প্রেয়ার হল। আজ কেবল প্রথম তিনটি সিনাগগ অক্ষত আছে।

ব্রেবোর্ন রোড, এজরা স্ট্রিট, পোলক স্ট্রিটকে মিলিয়ে দিয়েছে সিনাগগ। ব্রেবোর্ন রোডের ওপরে, ক্যানিং স্ট্রিটের আগে ডানদিকে নেভে শ্যালম সিনাগগ অবস্থিত যা
কলকাতায় সবচেয়ে পুরানো সিনাগগ। ১৮২৫ সালে নির্মিত এই সিনাগগটিকে ১৮৮৮তে পুনর্নির্মাণ করা হয়।

ক্যানিং স্ট্রিট আর ব্রেবোর্ন রোডের ক্রসিংয়ের কাছেই, হাওড়ার দিকে যাওয়ার
রাস্তার পাশে ইহুদিদের রয়েছে ইহুদিদের আরেক উপাসনালয় মাগেন ডেভিড সিনাগগ,
লাল ইটের এই অপূর্ব স্থাপত্য। কলকাতায় ইহুদিদের উপাসনাস্থলের মধ্যে অন্যতম
এটি। মাগেন ডেভিড সিনাগগটি ১৮৮৪ সালে এলিয়াস ডেভিড এজরা তাঁর বাবা জোসেফ এজরার স্মৃতিতে তৈরি করেছিলেন। ইতালীয় রেনেসাঁর স্থাপত্যরীতিতেই এই সিনাগগ তৈরি হয়েছে। এই চত্বরের রাস্তাটির নামও সিনাগগ স্ট্রিট হয়ে গিয়েছে। কলকাতায় ইহুদিদের উপাসনাস্থলের মধ্যে অন্যতম এটি। ভারত তথা সমগ্র প্রাচ্যে এমন সিনাগগ দুর্লভ।

ব্র্যাবোর্ন রোড থেকে বাদিকে ঘুরে পোলক স্ট্রিট ধরে একটি দূরেই ​মানুক লেনে
দাঁড়িয়ে রয়েছে ইহুদিদের আরেকটি উপাসনালয় বেথ এল সিনাগগ। হিব্রু ভাষায়
'বেথ-এল' মানে 'ঈশ্বরের বাড়ি'। ​১৮৫৬ সালে ২৬, পোলক স্ট্রিটে জমি কিনে
ডেভিড জোসেফ এজরা এবং ইজিকিয় জুডা বেথ এল সিনাগগ তৈরি করেন। কিন্তু মাগেন ডেভিড সিনাগগ তৈরি পর যখন বেথ এল তার কৌলীন্য হারাতে বসে, তখন এলিয়াস সালোম গাব্বে ঢেলে সাজান বেথ এল সিনাগগকে ঢেলে সাজাতে শুরু করেন। সৌন্দর্য আর স্থাপত্যে এটিও অনন্য।

মাগেন ডেভিড সিনাগগ এবং বেথেল এল-এর সংস্কার করার সম্প্রতি, সিনাগগ দু'টি
খুলে দেওয়া হয়েছে। তিলোত্তমার সাবেকিনায়া ধরা দেয় সিনাগগে। ডেভিড সিনাগগের
ভিতরে নৈঃশব্দ্যের স্বর্গরাজ্য। উঁচু জানলা আর ছাদে লাগানো বহু রঙয়ের কাচের
টুকরো থেকে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে সিনাগগের ভিতরে অপরূপ শোভার সৃষ্টি
হয়। সুবিশাল হলের মাঝে মঞ্চের মতো জায়গা। সেখানেই রাবাই, অর্থাৎ ইহুদি
পুরোহিতরা বিশিষ্টদের নিয়ে প্রার্থনার সময় দাঁড়াতেন। হলের শেষ প্রান্তে,
কারুকার্যময় কাঠের রেলিং দিয়ে ঘেরা ঘর ও গ্যালারির মতো একটি জায়গা রয়েছে।
সিঁড়ি দিয়ে সেখানে উঠতে হয়। ঘরে রয়েছে তিনটি দরজা। এর ভিতরেই ইহুদিদের
পবিত্র গ্রন্থ তোরা রাখা থাকে।

ইহুদিদের ধর্মশাস্ত্রের প্রথম পাঁচটি গ্রন্থের সমাহার 'তোরা'। সেখানে, একটি
হাফ ডোম বা অর্ধ গম্বুজ। ঘন নীল দেওয়ালে সাদা সোনালী তারা, মাঝের দরজার উপর রয়েছে ইহুদি ধর্মের প্রতীক মেনোরা বা বাতিদান আর মাগেন ডেভিড। মেনোরার দুই দিকে তিনটি করে মোট ছটা শাখা বা ব্রাঞ্চ থাকে। মেনোরার পাশে ছটি মুখের তারা থাকে, একে মাগেন ডেভিড বা ইহুদি শিল্ড অব ডেভিড বলে। এই ছয় মুখের তারার অর্থ, ঈশ্বর পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ উপর এবং নীচ; এই ছয় দিক দিয়ে ভক্তকে রক্ষা করেন। মাঝের দরজার ঠিক ওপরে রয়েছে একাধিক হিব্রু ইনস্ক্রিপশন। এরই সঙ্গে রয়েছে টেন কম্যান্ডমেন্টস বা আসেরেত হাদিব্র। ৬১৩টি নির্দেশের মধ্যে
প্রথম ১০টি নির্দেশ যা ইহুদিরা পালন করে। প্রতিটি দরজার পরদাতেও টেন
কম্যান্ডমেন্টস রয়েছে। সিনাগগের মূল হল থেকে উপরে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে।
ব্যালকনির মতো এই জায়গায় মহিলারা প্রার্থনা করতেন। বেথ এল-এর মার্বেলের
সিঁড়ি পেরিয়ে ভিতরের বিরাট হলঘরে ঢুকতে হয়। বিরাট ঝাড়লণ্ঠন। ব্যালকনি ঘেরা
জায়গা মেয়েদের প্রার্থনার জায়গা, এখানে দুটি তোরা এখনও সংরক্ষিত রয়েছে।

কলকাতার সব সিনাগগ দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন মুসলমানরা। তোরা যে ঘরে রক্ষিত আছে সেখানেও তারা ঢুকতে পারেন। প্রার্থনার সময় ইহুদিরা টুপির মতো কিপা পরে মাথা। ইহুদিদের প্রার্থনা করার জন্যে কমপক্ষে দশ জন পুরুষ দরকার, যাকে
হিব্রুতে মিনইয়ান বলা হয়। লোকের অভাবে নিয়মিত প্রার্থনা আর হয় না। কিন্তু
কেউ কেউ নিয়মিত সিনাগগে আসেন, প্রথা মতো শুক্রবার এসে জলে ভাসমান মোম
জ্বালিয়ে যান। শনিবার প্রার্থনায় বসেন। নিজেদের মতো করে ঈশ্বরের আরাধনায়
ব্রতী হন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...