যিনি মনের অন্ধকার, সভ্যতার অন্ধকার, সমাজের অন্ধকার, অভাবের অন্ধকারের মাঝে আমাদের জেগে থাকার কথা বলেন; তিনিই জাগরণের দেবী। সেই দেবীর নাম, 'কোজাগরী লক্ষ্মী'। দেবীর আবাহনকাল কার্তিকের কোজাগরী পূর্ণিমা। তিনি যেন পূর্ণিমাতে পূর্ণ আলোকদাত্রী হয়ে আবির্ভুত হন। যেন আমাদের জীবনে সমৃদ্ধির আলো এনে দেবার ব্রত তুলে নেন নিজের হাতে। বলেন, আলোয় জাগো, ভালোয় থাকো, চেতন হও, সচেতন রও, ঋদ্ধ হও, সমৃদ্ধ হও! তখন রাতের আঁধার, পূর্ণিমার আলো, জাগরণের কথা--প্রতীকের আড়াল ছেড়ে অদ্ভুত সুন্দর এক দ্যোতনা তৈরি করে।
আমরা গেরস্ত মানুষেরা দেবী-দেবীদের নিত্য ডাকি। কিন্তু, দেব-দেবীদের মধ্যে একমাত্র লক্ষ্মী ছাড়া আর কেউ আমাদের ডাকেন না। তিনি ডাকেন, ‘কে জাগেরে, কে জাগেরে’ বলে। তাঁর সেই 'কে জাগেরে' ডাকটিকে অপভ্রংশ করে আমরা দেবীর নাম দিয়েছি, 'কোজাগরী লক্ষ্মী'। আর, যে পূর্ণিমায় তিনি আমাদের এভাবে ডাকেন, সেই পূর্ণিমার সঙ্গেও আমরা জুড়ে দিয়েছি 'কোজাগরী' কথাটি। তাকে বলি, 'কোজাগরী পূর্ণিমা'।
আজ কার্তিকের সেই কোজাগরী পূর্ণিমা। পূর্ণ চাঁদের মায়ায় আজ সারাটি রাত জেগে থাকার সাধনা আমাদের। কারণ, দেবী আজ আমাদের ডাকতে ডাকতে সারারাত সপারিষদ ভ্রমণে কাটাবেন পৃথিবীর পথে। জাগার মতো জেগে থাকতে পারলে, আমাদের ঘুমন্ত চৈতন্যকে কুলকুন্ডলিনীর মতো জাগিয়ে ফেলতে পারলে তবেই আমরা তাঁর ডাক শুনতে পাব। তখন দেবী আমাদের কৃপা করবেন, আমাদের মনস্কামনা পূর্ণ করবেন। আমরা ধন্য হব। কিন্তু, দেবী রাতের কোন্ প্রহরে কোন্ ভক্তের দোরে কখন যে ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়বেন, আমরা কেউ জানি না। তাই সারারাতই জেগে থাকার নিয়ম।
কোজাগরী লক্ষ্মীদেবীর আর এক নাম, 'গজলক্ষ্মী'। তাঁর এ-নাম কেন হল, 'গজ' অর্থাৎ হাতিই বা কেন তাঁর সঙ্গী হল--এবার সে-সব কথাই চলুন পুরাণ ও লোকঐতিহ্য খুঁড়ে বিচার করি :
পুরাণ বলেন, দেবতা ও অসুরদের সম্মিলিত সমুদ্রমন্থনের সময় উঠে এসেছিল পারিজাত, ঐরাবত, অমৃত। আর, উঠে এসেছিলেন দেবী লক্ষ্মী। দেবীর সঙ্গে উঠে আসা সমস্ত কিছুর মধ্যেই ছিল জগতমঙ্গলের শক্তি। ঐরাবত সৌভাগ্য আর ঐশ্বর্যের আধার। তাই তাকে অধিকার করে নিয়েছিলেন দেবরাজ ইন্দ্র, যাতে তিনি ঐশ্বর্যময় হয়ে থাকতে পারেন সর্বক্ষণ। স্বর্গের রাজার অনুসরণে একদা তাঁরই মতো ঐশ্বর্যময় হয়ে উঠতে মর্ত্যের রাজাদের মধ্যেও রাজছত্র, মুকুট, সিংহাসনে হাতির প্রতীক আঁকা শুরু হল। হাতিশালায় হাতি রাখার ধুম পড়ে গেল। এবং আশ্চর্যরকমভাবে, সম্পদদায়ী ও সৌভাগ্যদায়িনী দেব-দেবীদের অনেকের সঙ্গেই কোন-না-কোনভাবে জুড়ে গেল হাতি। যেমন, বিশ্বের কারিগর বিশ্বকর্মার অন্যতম এক বাহন হল হাতি, সিদ্ধিদাতা গণেশের মাথা হল হাতির, মঙ্গলচণ্ডীর সঙ্গী হল হাতি। এমনকি ধনদায়িনী লক্ষ্মীর সঙ্গেও স্থান পেল দুটি হাতি, তাই দেবীর আর এক নাম হল, 'গজলক্ষ্মী'।
তবে, দেবীর রূপকল্পনায় রাজার চেয়ে প্রজার যোগই বেশি। 'হাতি' শুধু রাজার সৌভাগ্য ও সম্পদ কামনার প্রতীক হয়েই আটকে থাকল না, কৃষকপ্রজার সৌভাগ্য ও সম্পদের অভিলাষ হয়েও দেখা দিল। তাই তাঁরা কল্পনা করলেন যে, দেবী লক্ষ্মীর দু'পাশ থেকে দুটি হাতি দেবীর অঙ্গে জলসেচন করছে। এই সুন্দর ভাবনাটির সঙ্গে কৃষিজীবনের যোগ অত্যন্ত স্পষ্ট। আমরা জানি, বেদ-পুরাণের যুগে ঐরাবতের অধিকারী ইন্দ্র ছিলেন বৃষ্টির দেবতা। যুগটা ছিল নেহাতই বৃষ্টিনির্ভর কৃষির যুগ। তাই মহাধূমধাম করে সে-কালে ইন্দ্রের পুজো করা হত। ভক্তদের মনে হত, ইন্দ্রের নির্দেশে এই ঐরাবতই যেন তার শুঁড় দিয়ে মেঘের ভেতর থেকে জল ছিটিয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায়। অন্যদিকে আমাদের দেবীকল্পনায়, লক্ষ্মীর সঙ্গে প্রথম থেকেই শস্যের সম্পর্ক রয়েছে, ধানকে সরাসরি লক্ষ্মী হিসেবে আমরা পূজাও করি। ফলে, রূপকল্পনার এক বাঁকে শস্যের দেবী সরাসরি শস্য হয়ে উঠেছেন, আর ইন্দ্রের হাতি হয়ে উঠেছে শস্যের গায়ে জলসেচক, বৃষ্টি। এই সম্মিলনে কৃষকপ্রজার খেতে শস্যের ফলন বাড়ে, ফলন বাড়লে ঘরে সম্পদ বাড়ে, সৌভাগ্য সূচিত হয়। এভাবেই 'হাতি' অনুষঙ্গে দেবী যেমন রাজার জীবনে সম্পদদায়িনী ও সৌভাগ্যদায়িনী হয়ে উঠেছেন, তেমনি হয়ে উঠেছেন প্রজার জীবনেও। ফলে, তাঁদের বাসনা ও কল্পনার রঙ মিলে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে কোজাগরী দেবীর বর্তমান 'গজলক্ষ্মী' রূপটি। রূপময়ী সেই দেবীর কাছে আবহমান কাল থেকেই আবাহন কালে তাই আপামর ভক্তের একটাই অভিলাষ : আমাদের ভূমিকে শস্যশালিনী কর মা, আমাদের সম্পদশালী কর, সমস্ত অভাব ঘুচিয়ে দাও, আর মুছিয়ে দাও তোমার পূর্ণিমায় মনের-ঘরের সমস্ত অন্ধকার!