দুর্গাপুজো শেষ হওয়ার পর মায়ের বিসর্জন দেখে যখন একটা মন খারাপের রেশ তৈরি হয়, তখনই পুজো পুজো গন্ধ নিয়ে আবার মর্তলোকে এসে উপস্থিত হন সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্যের দেবী মা লক্ষ্মী। বাঙালির ঘরে ঘরে সকল মানুষ আবার মেতে ওঠেন নতুন করে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর তোড়জোড় করতে। আশ্বিন মাসের শেষ পূর্ণিমায় যে লক্ষ্মী পুজো হয় তাকেই কোজাগরী লক্ষ্মী পুজা বলে। কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর নির্ঘন্ট এবং এই পুজোর সাথে জড়িয়ে থাকা লৌকিক বিশ্বাসের সম্পর্কে চলুন জেনে নেওয়া যাক।
কোজাগরী শব্দটির উৎপত্তি ‘কো জাগতী’ কথা থেকে। এর অর্থ হলো কে জেগে আছো?। যার ধন-সম্পদ নেই, সে পাওয়ার আশায় জেগে আছে আর যার ধন-সম্পদ আছে সে হারানোর ভয়ে জেগে আছে। এই কোজাগরী লক্ষ্মী পুজা সম্পর্কে পুরাণে একটি গল্প প্রচলিত আছে, যেখানে বলা হয় যে, কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর দিন মা স্বয়ং মর্ত্যলোকে নেমে আসেন এবং তিনি সকলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আশীর্বাদ প্রদান করেন, তাই এই দিন সকল মর্ত্যবাসী রাত্রি জাগরণ করে লক্ষ্মীর পুজো করেন দেবীর আগমনের আশায়। এই দিন যে বাড়ির দরজা বন্ধ থাকে সেই বাড়ি থেকে দেবী মুখ ফিরিয়ে চলে যান, আর সেই গৃহে প্রবেশ করেন না।
২০২১ সালে কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর নির্ঘণ্টঃ ১৯ অক্টোবর সন্ধ্যে ৭.০৩ মিনিটে এই পুজোর সময় শুরু হবে আর ২০ অক্টোবর রাত ৮টা ২৬ মিনিটে এই পুজোর তিথি শেষ হবে। কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মী দেবীর আরাধনা প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বাংলার ব্রত’ বইতে লিখেছেন যে, দেবীর কাছে ভাল ফলনের কামনা করাই হলো এই পুজোর নৃতাত্ত্বিক কারণ। পুজো বা ব্রত কথার সাথে আলপনারও একটি সম্পর্ক রয়েছে। আলপনা আসলে মানুষের কামনার প্রতিচ্ছবি। দেবীর পুজোর উপাচার হিসেবে ফল, মিষ্টি, মোয়া, নাড়ু ইত্যাদি রাখা হয়। লক্ষ্মী পুজোর দিন মায়ের পায়ের যে আলপনা আঁকা হয় এমনটা বিশ্বাস করা হয় যে, ওই পথ দিয়েই মা গৃহস্থের ঘরে ঢুকবেন।
কোজাগরী লক্ষ্মীর প্রতি আচার নিবেদনের সাথে একটি লৌকিক বিশ্বাস জড়িয়ে আছে। পুজোর সময় মোট ১৪টি পাত্রে উপাচার রাখা হয় তারপর পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে জলদানের একটি রীতি রয়েছে। কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোয় কাঠের জলচৌকির ওপর লক্ষ্মীর সরাটিকে স্থাপন করা হয়। এইদিন কলাপাতার মধ্যে টাকা, স্বর্ণমুদ্রা, ধান, পান, কড়ি, হলুদ ও হরিতকি দিয়ে সাজানো হয় পুজোর স্থানটিকে।
বৈদিক শাস্ত্র ও বিভিন্ন পুরাণ অনুসারে পূজিতা দেবী লক্ষ্মী বাঙালির ঘরের দেবী। দুর্গাপুজো যেখানে বারোয়ারি পুজো, সেখানে প্রতি ঘরে ঘরে মেয়ে-বৌমারা মিলেই লক্ষ্মী দেবীর ঘট পেতে পুজো করে ফেলেন অনায়াসে। আসলে দেবী লক্ষ্মী চঞ্চলা হলেও ক্রোধ সম্পন্না দেবী নন, তাই তার পুজো করার আগে কোন সাতপাঁচ ভাবনায় পড়তে হয় না মানুষকে। লক্ষ্মী বারে সামান্য ফুল, বাতাসা আর পিঁড়ি ধুয়ে চাল পিটুলির আলপনা এঁকেই মায়ের যে পুজো করার রীতি আছে, কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার রাতে সেই পুজোটিকেই একটু বড় আকারে করা হয়।