সতীপীঠঃ কদুনগাল্লুরে হাজার বছরের প্রাচীন রহস্যময় তীর্থে রয়েছেন বিপদনাশিনী ‘মা ভদ্রকালী’

‘কদুনগাল্লুর ভগবতী মন্দির’ বা ‘কদুনগাল্লুর দেবীমন্দির’টি ‘শ্রী কুরুম্বা ভগবতী মন্দির’ নামেও সুবিখ্যাত। মন্দিরটি কেরালায় থ্রিসুরের কদুনগাল্লু শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। কেরালার শক্তিপীঠগুলির মধ্যে সবচেয়ে সুবিখ্যাত, সবচেয়ে প্রাচীন হল এই দেবীমন্দির। এই দেবীর মন্দির কারও কাছে একান্ন সতীপীঠের অন্যতম এক পীঠ; আবার কারও কাছে নিছক প্রাচীন এক শক্তিক্ষেত্র। তবে সমস্ত দ্বিমত দূরে সরিয়ে আপামর সকল ভক্তজন কিন্তু এই দেবীকে, তাঁর পীঠস্থানকে অত্যন্ত জাগ্রত বলে বিশ্বাস করে থাকেন। দেবীর পীঠস্থানকে একান্নপীঠের অন্যতম পীঠ হিসেবে ধরলেও, এখানে দেবীর কোন অঙ্গ পতিত হয়েছিল, সে-সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। 

কদুনগাল্লুর হল কেরালার সবচেয়ে প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রাচীনকাল অর্থাৎ খ্রিস্টজন্মের আগে থেকেই এই শহর বন্দর-শহর হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল। দক্ষিণ ভারতীয় রামায়ণে এই শহর ‘মুরাচিপত্তনম’ নামে উল্লিখিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যে, বানররাজ সুগ্রীব সীতা-অন্বেষণের জন্য তাঁর বানরসেনাকে প্রথম এই স্থানেই পাঠিয়েছিলেন। দেবীমন্দিরটি এই শহরের মধ্যস্থলে অবস্থিত। আসলে, মন্দিরকে ঘিরে অর্থাৎ মন্দিরকে মধ্যে রেখে তার চারপাশে বসতি বাড়তে বাড়তে এই কদুনগাল্লুর শহরটি গড়ে উঠেছে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, শহরটি যদি খ্রিস্টজন্মের আগের যদি হয়, তাহলে মন্দির বা দেবীর পীঠস্থানটি কত পুরাতন! এই প্রাচীন মন্দির তথা পীঠস্থানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন মা ভদ্রকালী।

দেবীর মন্দিরটি প্রথম লগ্নে আসলে শিবের মন্দির ছিল; পরবর্তীকালে কীভাবে তা দেবীমন্দির হয়ে উঠল, তা নিয়ে দু’টি প্রচলিত কাহিনি রয়েছে; সেগুলো হল এই রকমঃ

পৌরাণিককালে দারুকা নামে এক দৈত্য ছিল। সে একবার দারুণ তপস্যায় মহাদেবকে তুষ্ট করে তাঁর নামে মন্দির নির্মাণের নির্দেশ লাভ করেছিল। দারুকা ইষ্টের ইচ্ছা পূর্ণ করলো। মন্দির তৈরি করাল, মন্দিরে মহাদেবের লিঙ্গমূর্তি প্রতিষ্ঠা করলো। পূজা শুরু করলো। সব কিছু বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু তার মধ্যেই একদিন বিপত্তি ঘটল।

একদা এই মন্দিরের পথ ধরেই আসছিলেন ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের অন্যতম অবতার পরশুরাম। তিনি বহুদূর থেকেই মানসনেত্রে দেখতে পেলেন এই মন্দিরক্ষেত্রের ওপরের দেবী শক্তির শক্তিভাণ্ডার, প্রাচীন সতীক্ষেত্র। তিনি তখন এই মন্দিরক্ষেত্রে এসে কাঁঠাল কাঠে নিজের হাতে দেবীর মূর্তি নির্মাণ করলেন এবং মন্দিরের প্রধান দেবীরূপে সেই মূর্তিকে প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনি দেবীকে ‘মা ভদ্রকালী’ বলে সম্বোধন করে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই থেকে দেবীকে অধিকাংশ ভক্তজনই ‘মা ভদ্রকালী’রূপে আরাধনা করে এই নামেই সম্বোধন করেন।

যাই হোক, লোকমুখে চরমুখে শিবমন্দিরে দেবীমূর্তি প্রতিষ্ঠার খবর দৈত্যরাজ দারুকার কানে পৌঁছতে বিলম্ব হল না। অমনি ভয়ানক রেগে সে সসৈন্যে পরশুরামকে আক্রমণ করলো। পরশুরাম জগতের অজেয় বীর, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা; তিনি একাই দারুকাকে পরাস্ত করার ক্ষমতা রাখেন। তথাপি দেবী তাঁর এই প্রিয় পুত্রকে দৈত্যের আক্রমণের মুখে একা হতে দিলেন না। তিনি রণরঙ্গিণী বেশে আবির্ভূতা হলেন পুত্রের ঢাল হয়ে। পরম শক্তময়ী দেবী একাই বহুধা হয়ে লড়াই শুরু করলেন দারুকা ও সৈন্যদের সঙ্গে। তারপর অবলীলায় সমস্ত সৈন্যকে বিনষ্ট করে দারুকার কেশ আকর্ষণ করে তার মুণ্ডচ্ছেদ করে তাকে হত্যা করলেন। মন্দিরে দেবীমূর্তির এক হাতে এই দারুকার প্রতিকীমূর্তি সেই থেকে আজও দেখা যায়। এবং, এই সময় থেকেই শিবের প্রাচীন মন্দিরটি দেবীমন্দির হিসেবে সাধারণের কাছে শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের সঙ্গে গৃহীত হয়। দেবীও সন্তানের রক্ষাকারিণী জননী হিসেবে ভক্তজনের পরম আরাধ্যা হয়ে ওঠেন। তবে দৈত্য-প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গটি মন্দিরে আজও রয়েছে এবং তা শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজিত হয়।

অন্য কিংবদন্তিটির সঙ্গেও জড়িয়ে আছেন পরশুরাম। তিনি বহুদূর থেকে শিব মন্দিরের চত্বরে দেবী শক্তির উপস্থিতি অনুভব করেন। সেই অনুভবের টানেই মন্দিরের শক্তিভাণ্ডারের সামনে উপস্থিত হন। সেটিকেই দেবী দুর্গার প্রতীক হিসেবে পূজা শুরু করেন। দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন মোরগ এবং কারণবারি। এই দুই অর্ঘ্য উৎসর্গ করতেই স্বয়ং পরশুরাম দেবী ‘মা কুরুম্বা’র দারুমূর্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যান। তারপর স্বয়ং দেবীর আদেশে মন্দিরের গর্ভগৃহে সেই মূর্তি ভক্তজনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পূজা শুরু হয়।

যাই হোক, সমগ্র কেরালায় দেবী কালীর জাগ্রত চৌষট্টিটি মন্দির রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হল এই দেবী ভদ্রকালীর মন্দিরটি। দেবীমাহাত্ম্য ছাড়াও এই দেবীতীর্থের প্রধান আকর্ষণ মন্দির ও মন্দিরক্ষেত্রের অপরূপ পরিবেশ। মন্দিরটি ছড়িয়ে রয়েছে প্রায় দশ একর জায়গা জুড়ে। মন্দির চত্বরের মধ্যে অসংখ্য প্রাচীন বট ও অশ্বত্থ বৃক্ষ রয়েছে। মন্দিরের গড়ন কেরালার প্রথাগত স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত। কংক্রিট ও কাঠের স্তম্ভের ওপর বর্গাকার ও আয়তাকার অসংখ্য চারচালা দিয়ে মন্দিরক্ষেত্রটি সাজানো রয়েছে। এই চালাগুলোই মন্দির। মূল মন্দিরে রয়েছেন স্বয়ং দেবী। অন্যান্য চালায় রয়েছেন আরও আরও অনেক দেবদেবী।

মূল মন্দিরের গর্ভগৃহ উত্তরমুখী। গর্ভগৃহের প্রধান বেদিতে রয়েছে দেবী ভদ্রকালীর প্রাচীন দারুমূর্তি। মূর্তিটি কাঁঠাল কাঠ খোদাই করে নির্মিত। মূর্তির উচ্চতা ছয়-সাত ফুট। দেবী অষ্টভুজা। তাঁর আট হাতের এক-একটিতে রয়েছে তরবারি, বর্শা, বল্লম, মুদ্গর, ধনুক ইত্যাদি; আর রয়েছে দৈত্য দারুকার ছিন্নমস্তক। দেবী উত্তরমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। দেবীর মাথায় সুদৃশ্য রত্নময় মুকুট। দেবীর সর্বাঙ্গ সোনার তবক দিয়ে নির্মিত অঙ্গাবরণে মোড়া। সেই সঙ্গে গলায় নানাবিধ স্বর্ণময় রত্নমালা। দেবীর মুখমণ্ডলে একদিকে অশুভশক্তির বিরুদ্ধে কালিকার ক্রোধ, অন্যদিকে বিপদ্গ্রস্ত সন্তানের জন্য রয়েছে অমোঘ বরাভয়, অপার্থিব আশ্রয়।

দেবীর একটি সিল্কের বস্ত্র গর্ভগৃহের পশ্চিম দেওয়ালে ঝোলানো রয়েছে, দেবীর প্রতীক হিসেবে। এই প্রতীক মন্দিরে আগত ভক্তজনেরা স্পর্শ করে পুজো করতে পারেন। এই মন্দিরটি কেরালার মধ্যে প্রথম মন্দির, যেখানে প্রচীনকাল থেকেই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র হিন্দুদের চারটি বর্ণ একত্রে প্রবেশ করে পুজো করতে পারত। দেবীপূজায় বা মন্দিরে-প্রবেশে কোন বর্ণগত বিধিনিষেধ ছিল না। এটা কেরালার বৈষম্যমূলক ইতিহাসের নিরিখে একটি বিশিষ্ট ব্যাপার। পুরোহিত দেবীর পূজা যে-ভাবে করেন, সেই বিধি প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে তা নাকি দেবীর আপন নির্দেশ মেনেই তৈরি।  

মন্দিরের গর্ভগৃহের লাগোয়া ছোট ছোট কক্ষে বীরভদ্র, ক্ষেত্রপাল, বাসুরিমালা, গণপতি প্রভৃতি দেবতা, দেবী, ও গণের মূর্তি রয়েছে। তাঁরা নিয়মিত পূজিতও হন। এছাড়া গর্ভগৃহে দেবী ভদ্রকালীর পাশাপাশি সপ্তমাতৃকাদের (ব্রাহ্মী, মাহেশ্বরী, বৈষ্ণবী, ইন্দ্রাণী, কুমারী, বারাহী, নৃসিংহী) উত্তরমুখী মূর্তিও রয়েছে।

দেবীর মন্দির বড়ই রহস্যময়। এই মন্দিরের অনেক গুপ্তপথ, গুপ্ত দরজা ও গুপ্ত প্রকোষ্ঠ রয়েছে। প্রতিটি প্রকোষ্ঠে, এমনকি গর্ভগৃহেও তেলের দীপমাত্র আলোর আধার। ফলে, অন্দরে আলো-আঁধারির অভূতপূর্ব রহস্যময় সমাবেশ। গর্ভগৃহে পুরোহিত যখন দেবীর পুজো করেন, তখন দেবীর মুখোমুখি বসেন না। দেবী উত্তরমুখী, তিনি বসেন পুবমুখী হয়ে। পুবের দেওয়ালে রয়েছে তিনটি শ্রীচক্র বা শ্রীযন্ত্র আঁকা। দেবীর প্রতীক হিসেবে তিনি এই যন্ত্রগুলির পুজো করেন। কিংবদন্তি অনুসারে, স্বয়ং আদি শঙ্করাচার্য এই মন্দিরে এসে উৎকীর্ণ করান। ভক্তজনের ধারণা, দেবীর সমস্ত শক্তির উৎস এই যন্ত্রগুলো। এই যন্ত্রগুলো সাধারণ মানুষ দেখতে পান না, সোনার পাতের পর্দা দিয়ে সাধারণের দৃষ্টির আড়ালে এগুলো রাখা হয়েছে। এই চক্রগুলোর বিপরীত দিকে একটি দরজা আছে। একমাত্র সেই দরজা দিয়েই শ্রীযন্ত্রের পিছনের গবাক্ষবিহীন একটি গুপ্ত কক্ষে পৌঁছানো যায়। পুরোপুরি গ্রানাইট পাথরে নির্মিত এই কক্ষটিকে দেবীর শক্তির ভাণ্ডার হিসেবে ভাবা হয়। বিশেষ তিথিতে খুব ভোরে কদুনগাল্লুরের মহারাজেরা এলে এই কক্ষের দরজা খোলা হত। রাজবংশের পতনের পর কয়েক শ’ বছর ধরে আর ঐ দরজা খোলা হয় না। স্বভাবতই এটা থেকে ঐ কক্ষের রহস্যময়তা বেড়েছে, মানুষ নিজের মতো করে নানান ব্যাপার অনুমান করার অবসর পেয়েছে; তবে এই গুপ্ত কক্ষে আসলে কী আছে, তা এখনও অব্দি মন্দিরের বাইরের মানুষ কেউ জানতে পারে না।  

দেবীমন্দিরের প্রধান উৎসব ‘ভরনি উৎসব’। মার্চ-এপ্রিল মাসে বিশাল জাঁকজমকের এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এতে নানান অদ্ভুত অদ্ভুত লোকাচারের মধ্য দিয়ে নাকি অনেকের ওপর দেবীর ভর হয়, ভরগ্রস্তেরা সাধারণের মধ্যে যারা জানতে চায়, তাদের ভূত-ভবিষ্যৎ বলে থাকে। গাজনে যেভাবে ভক্তেরা আত্মনির্যাতন করেন কোথাও কোথাও, এখানেও এই উৎসবের সময় তা বহুল পরিমাণে দেখা যায়। শোনা যায়, এই উৎসবের সময়  দেবীমন্দিরে এছাড়াও মকর সংক্রান্তির দিন থেকে শুরু করে চারদিনের আর-একটি বিশেষ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবের নাম, ‘থালাপ্পোলি উৎসব’। এই দুই উৎসব উপলক্ষেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষের আগমন হয়; তাঁদের মধ্যে কেউ ছুটে আসেন এখানকার রহস্যময়তার সন্ধানে, কেউ বা অর্জন করতে আসেন দেবীর কৃপা। আর সেভাবেই নিরন্তর বয়ে চলে বহুধা শক্তি-পূজার বিবিধ স্রোত।...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...