কলকাতায় গাইতে এসে প্রয়াত হয়েছেন কেকে, স্রষ্টারা চলে যান কিন্তু থেকে যায় সৃষ্টি। কেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁর সৃষ্টি বেজে চলেছে, কালের মন্দিরা হয়ে কেকে-এর সুরগুলো থেকে যাবে চিরকাল। কখনও ফোন বা কখনও মাইকে বেজে উঠবে কেকে-র গান। এই প্রজন্ম ভালবাসতে শিখে তাঁর গানের মাধ্যমেই। কখনও প্রেমিকা বলে উঠেছে, লবো কো লবো পে সাজাও বা তু হি মেরি সব হ্যায় সুভা হ্যায় মেরা। হয়ত প্রেয়সীকে বলে জারা সি দিল মেই দে জাগা তু কিংবা ক্যায়া মুঝে পেয়ার হ্যায়। আবার মনের মানুষকে দেখে বলেছে, আঁখো মে তেরি আজব সি আজব সি আদায়ে হ্যায়। তাঁর কণ্ঠই জুগিয়ে গিয়েছে প্রেমের ভাষা।
সেই মানুষটির প্রেমের কাহিনী কেমন ছিল? খুব অল্প বয়সেই কেকে-র প্রেমের শুরু। তিনি তখনও কেকে হয়ে ওঠেননি। প্রেমের ভিত্তি হল সঙ্গীর প্রতি বিশ্বাস। এই বিশ্বাসে ভর করেই টিকে থাকে সম্পর্ক। কেকে ও জ্যোতির ক্ষেত্রেও তাই। শোনা যায়, কৈশোর জীবন থেকেই একে অপরের সঙ্গে পরিচয় ছিল কেকে এবং জ্যোতির। তখন ক্লাস সিক্স। কৈশোরের প্রেম জ্যোতির হাত ছেড়ে যাননি কেকে। মৃত্যু গত ৩১মে তাঁদের আলাদা করল! সত্যি করতে পারল কী?
আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতের সঙ্গীতজগতে রাজত্ব করেছেন কেকে। কাজের ফাঁকে গুন গুন করে মালায়ালি ভাষায় গান গাইতেন তাঁর মা। সেসব গান লুকিয়ে রেকর্ড করতেন তাঁর বাবা। এইসব রেকর্ডই ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনতেন কেকে। পেতেন অনুপ্রেরণা। স্বপ্ন দেখতেন সঙ্গীতশিল্পী হবে। মায়ের গানই তারা অনুপ্রেরণা।
তখন দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র কেকে, প্রথমবার মঞ্চে গান করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। কলেজ জীবন শেষ হওয়ার পরেই ফুরিয়ে যেতে বসেছিল কেকে-র গায়ক হওয়ার স্বপ্ন। কারণ মধ্যবিত্ত সংসারের দায়িত্বভার, স্কুলজীবনের প্রেয়সীকে বিবাহ, সংসারের আর্থিক ভারগ্রহণ; এসব কিছুই ভাবিয়ে তুলেছিল তাঁকে। গান গেয়ে কি সংসার চালানো যায়? তাই চাকরির অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন কেকে। দিল্লির একটি সংস্থায় কাজ নিয়েছিলেন সেলসপার্সনের।
কেকে তখনও প্রতিষ্ঠিত নন, তখন তাঁর প্রতি বিশ্বাস রেখেছিলেন কেকের স্ত্রী জ্যোতি। কিন্তু বিশ্বাস রেখেছিলেন জ্যোতি। মেয়ে বড় মানেই বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় শুরু! কিন্তু প্রেমিকের চাকরি না থাকায় কত মেয়েকে যে চোখের জল ফেলতে হয়েছে নীরবে তার কোন ইয়োত্তা নেই। কারণ, বাড়ি থেকে সম্পর্কের বিষয় মানবে না; বেকার ছেলের সঙ্গে কোনভাবেই বিয়ে দেবে না। বিয়ে করার জন্য ছেলেদের চাকরি খুবই প্রয়োজন। কত বেলা বোস যে আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছেন কেউ তা জানেন না। কেকে-কেও একই পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছিল। প্রেমিকাকে বিয়ে করার জন্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তিনি। বলা হয়, সমবয়সীদের প্রেম হয়না। কারণ, ছেলেদের প্রতিষ্ঠিত হতে একটু বেশি সময় লাগে, ততদিনে মেয়েদের বিয়ে হয় যা। কিন্তু কেকে-র ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হয়েছিল, পাশে ছিলেন জ্যোতিকে।
১৯৯১ সালে বিবাহ বন্ধনে বাঁধা পড়েন কেকে ও জ্যোতি। তবে এই বিয়ে পর্যন্ত পথ মসৃণ ছিল না। সেই সময় কোন চাকরি করতেন না বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী। তাই তাঁর উপর চাকরির চাপ ছিলই। কারণ ‘বেকার’ ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু কেকে ঠিক করেই ফেলেছিলেন বিয়ে জ্যোতিকেই করবেন, প্রতিজ্ঞাবদ্ধও ছিলেন।
তাই একপ্রকার বাধ্য হয়েই জ্যোতিকে বিয়ে করার জন্য সেলসের চাকরি নিয়েছিলেন কেকে। তারপর থেকে ৩১ বছর পার হয়েছে। একে অপরের হাত ছেড়ে দেননি তাঁরা। যদিও সেই সেলসের চাকরি খুব বেশিদিন করতে পারেননি শিল্পী। বরং, তিন মাস পরেই তাঁকে সেই চাকরি ছাড়তে হয়েছিল। মাস ছয়েকের মধ্যেই চাকরি নাজেহাল করে তুলেছিল তাঁকে। তবে সেই দুঃসময়ে তাঁর পাশে দাঁড়ান তাঁর স্ত্রী এবং বাবা। তাঁদের অনুপ্রেরণাতেই ফের সঙ্গীতজীবনে প্রত্যাবর্তন করেন কেকে। কি-বোর্ড কিনে শুরু হয় গানের অনুশীলন। দুই বন্ধু শিবানী কাশ্যপ এবং শৈবাল বসুর দৌলতে জিঙ্গেল গাওয়ার সুযোগও মেলে দিল্লিতে। সেটা ১৯৮৫ সাল। আনুষ্ঠানিকভাবে সেখান থেকেই শুরু তাঁর গানের কেরিয়ার।
যে সময়ে কেকে ও জ্যোতির সম্পর্ক ছিল সেই সময় প্রতিষ্ঠিত শিল্পী ছিলেন না কেকে। ১৯৯১ সালে বিয়ে করেন তাঁরা। তার কেকে-এর প্রথম অ্যালবাম মুক্তি পায় ১৯৯৯ সালে। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। আজ দুই দশক পরেও তাঁর প্রত্যেকটি গান একইভাবে জনপ্রিয়।
প্রতিষ্ঠিত মানুষকে বিয়ে করলে জীবনযাপন অনেক সহজ হয়। কিন্তু ভালবাসার মানুষের স্বপ্নউড়ানের পথচলার সঙ্গী হওয়ার আনন্দ অনেক বেশি। অনিশ্চিত সেই পথচলায় বারবার বাধা আসে। কঠিন সময় আসে। কিন্তু সব শেষের জয়টার যে তুলনা হয়না। সেই জয়ের স্বাদ দুজনে মিলেই উপভোগ করা যায়। যেমনটা করেছিলেন কেকে এবং জ্যোতি। খ্যাতির শিখরে পৌঁছেও অটুট ছিল তাদের সম্পর্ক। কেকে জীবনের শেষ গান গেয়েছেন "হাম রাহে ইয়া না রাহে কাল..." আজ সত্যিই কেকে নেই! কিন্তু জ্যোতির সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত, তাঁর প্রতিটি গানের মধ্যে দিয়ে তিনি বেঁচে থাকবে জ্যোতির কাছে। কারণ ভালবাসার বাঁধন যে এতো সহজে মুক্ত হওয়ার নয়।