“আমার কোনও ফিল্মি অ্যাওয়ার্ড না পেলেও চলবে। এই যে আমাকে ঘিরে এত মানুষের আবেগ-উন্মাদনা এটাই যথেষ্ট। ওইসব অ্যাওয়ার্ড না হয় আমার মৃত্যুর পর পেলাম”।
নিজের গান আর পুরস্কারের পাওনা নিয়ে এই ছিল তাঁর মন্তব্য। চেয়েছিলেন তাঁর গান মুখে মুখে ফিরুক শ্রোতাদের। তাঁর গানই হোক তাঁর পরিচয়। শেষপর্যন্ত তাই হয়েছিল। মঞ্চের গায়ক মুখ চেনা হোক বা না হোক গান দিয়েই চেনা হয়ে যেতেন তিনি। নাম যে কেকে।
মাটির কাছাকাছি থাকা গেলে তবেই মাটির স্পর্শ থাকবে গানে। আঁধার রাতে একলা হয়ে শুনলে ভিজবে চোখের কোণ। উপচে পড়া জল আঁখিপল্লব ভিজিয়ে নেমে আসবে গাল বেয়ে। তবেই না গান ‘গান’ হয়ে উঠবে। এই ভাবনা থেকে কখনও সরেননি তিনি।
তাই ২০২২-এর মে মাসের ২২ তারিখে, তাঁর হঠাৎ মৃত্যুর অভিঘাত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন আসমুদ্র হিমাচলকে। ধূসর কালো পোস্টার ঘিরে মাইক্রোফোন হাতে একটা মুখ। স্মিত হাসি, কণ্ঠে গান আর দর্শকদের দিকে হাতের ইশারা- এমন ছবির ঝড়ে ভেসে গিয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়া। ভূ-ভারত জুড়ে হাহাকারে মিশে একটাই শব্দ- ‘আলবিদা’।
দর্শকদের খুব কাছের হয়েও যেন তিনি দূরের। চাইতেন আগে সামনে আসুক তাঁর গান। তারপর তিনি। তাঁকে পার্টি, গসিপ, গান দুনিয়ার রাজনীতি বা সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে পাওয়া যায় না, কেকে’কে। তিনি থাকতেন নিজের সাধনায়।
শিল্পীর শুধু সাধনা সম্বল, মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন এই সত্যকে। গান শিখেছিলেন নিজে নিজে। শুনে শুনে। প্রতিভা আর পরিশ্রমে কতখানি বিশ্বাস আর জোর থাকলে একজন সেলফ টট আর্টিস্টের জীবনে প্রথম বড় ব্রেক আসে এ আর রহমানের থেকে। তারপর সঞ্জয় লীলা বনশালী, গুলজার, বিশাল ভরদ্বাজ, ইসমাইল দরবার কে নয়!
গান ছিল তাঁর গীতা-বাইবেল-কোরান। সুখ-দুখ আনন্দ বেদনার নামও গানই। অন্তরালে থেকে নিরন্তর চর্চায় ব্যস্ত থেকেছেন কেকে। মিউজিকরুমের মাইক্রোফোনের সামনে থাকা যতটা জরুরি মনে করেছেন ততটা জরুরি কোনওদিনই মনে করেননি ক্যামেরার সামনে থাকাকে। বরং অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ শ্রোতাদের সামনে, মঞ্চের ওপর। নিজেই বলতেন ‘আড়ষ্ট লাগে’। সচেতনভাবেই এড়িয়ে চলতেন ক্যামেরা।
অন্তরালে থাকার এই অভ্যাসের কারণেই বহু শ্রোতা দিনের পর দিন অত্যন্ত ভালোবেসে কেকের গান শুনে যাওয়ার পরেও জানতে পারেননি যে শিল্পীর নাম কেকে। যেভাবে শ্রোতাদের কাছে তাঁর গান পৌঁছেছে সেভাবে পৌঁছাননি কেকে। পৌঁছেছেন তাঁর আকস্মিক প্রয়াণের পর। যেভাবে মানুষ জেনেছে কেকে আসলে ‘কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ’। তাই তাঁর প্রয়াণ গানপ্রেমীদের কাছে হয়ে উঠেছে আরও দুঃসহ।
গান কখনও সীমান্ত মানে না। শহর মানে না। ঘর মানে না। বার মানে না। শিল্পীও তাই। যেখানে তাঁর গান তিনি সেখানেরই মানুষ। ক-এ কলকাতা। ক-এ কেকে। গানপাগল এই শহর তাঁর শেষ মঞ্চ। এই শহরে এসেই গান থেমেছিল শিল্পী। দক্ষিণ কলকাতার নজরুল মঞ্চে রাখা কেকে-র অনুষ্ঠানের গানের লিস্ট ছবি হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বাতাসের বেগে। সাথীহারা কান্নায় ভেসেছিল কলকাতা। যাত্রাপথে সুর ছড়িয়েছিল সাধ্যমতো।
আজও তাঁর জন্মদিনে কাঁদছে এই শহর। অন্তরালপ্রিয় এক শিল্পীকে এভাবে বিদায় জানিয়ে ভালো নেই শহর...
আভি আভি তো মিলে হো
আভি না করো ছুটনে কি বাত...