প্রতিভার নাম কিশোর কুমার

তিনি ছিলেন "দ্য জায়েন্ট অফ ইন্ডিয়ান মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি", জায়েন্ট অফ হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বললেও খুব ভুল হয় না। কারণ তিনি সর্বকালের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় গায়ক, পাশাপাশি অভিনেতা হিসেবেও অনবদ্য, সুরকার, প্রযোজক, পরিচালক, সব কটি ক্ষেত্রে তিনি চূড়ান্ত সফলতা পেয়েছেন। ভদ্রলোকের নাম আভাস কুমার গঙ্গোপাধ্যায়। নামটা শুনে পাঠকদের ভুরু দুটো কুঁচকে সেকেন্ড ব্র্যাকেট হয়ে গেল তো? আকাশ পাতাল ভেবেও এই নামের কোনো গায়ক বা অভিনেতাকে মনে পড়ছে না? তাঁর বড় দাদার নাম ছিল কুমুদ লাল গঙ্গোপাধ্যায়। এই রে! আরো কনফিউজড হয়ে গেলেন তো? না না, আর কোনো বিভ্রান্তিতে আপনাদের রাখবে না এই নিবন্ধ-প্রণেতা। এই ভদ্রলোক হলেন আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলের প্রিয় গায়ক কিশোর কুমার.. এক বিস্ময়কর প্রতিভা..আর কুমুদ লাল গঙ্গোপাধ্যায় হলেন অশোক কুমার।

কিশোর কুমার যে কত বড় মাপের এবং কতটা জনপ্রিয় গায়ক সে ব্যাপারে নতুন করে বলার কিছুই আর নেই। একশো পঁচিশ কোটি ভারতবাসীর মোটামুটি নব্বই শতাংশই সেই তথ্য জানেন। আজ বরং তাঁর সম্পর্কে এবং তাঁর গান নিয়েও নতুন কিছু কথা জানানো যাক।

কিশোর কুমার ছিলেন গায়ক কে এল সায়গল এর খুব বড় ভক্ত। তার প্রথম দিকের গানগুলিতে কে এল সায়গলকে অনুকরণের ছাপ স্পষ্ট। সেইসময় এক ঘরোয়া আড্ডায় এস ডি বর্মন তাঁকে পরামর্শ দেন অন্য গায়ককে অনুকরণ না করে নিজস্ব গায়কী তৈরি করতে। এর পর কিশোরকুমার তাঁর গায়কীতে পাশ্চাত্য প্রভাব আনেন। মার্কিন শিল্পী জিমি রজার্স এবং নিউজিল্যান্ডের গায়ক টেক্স মর্টনের গান শুনে নিজের গায়কীরও সঙ্গী করে নেন ইয়োডলিংকে যার উদাহরণ হিসেবে বেছে নেওয়া যেতে পারে.."জিন্দেগী এক সফর হ্যায় সুহানা, ইয়াহাঁ কাল কেয়া হো কিসনে জানা"।

তাঁর দাদামণি অর্থাৎ অশোককুমার কিন্তু চাননি যে কিশোর কুমার গায়ক হন, তিনি চেয়েছিলেন তাঁর মতো কিশোরও অভিনেতাই হোন। কারণ তিনি ভেবেছিলেন যে গায়ক হওয়া তো অত সহজ নয় তার জন্য অধ্যবসায় লাগে পরিশ্রম করতে হয় নিয়মিত রেওয়াজ করতে হয় যেখানে রেওয়াজ তো দূরের কথা কিশোরের সেরকম কোনো প্রথাগত তালিমও ছিল না। কিন্তু সত্যিকারের প্রতিভা তো ঈশ্বরের দান। আর কিশোর কুমার ছিলেন তাইই। "চলতি কা নাম গাড়ি" ছবির গান রেকর্ডিং হবে। গাইবেন তিন মহারথী - মান্না দে, মহম্মদ রফি এবং কিশোর কুমার স্বয়ং। খুব খটমট গান। মান্না দে এবং মহম্মদ রফি নিয়মিত প্র্যাকটিস করছেন। রিহার্সালের দিন কিশোর কুমারের কোনও পাত্তা নেই! মান্না দে, মহম্মদ রফি চিন্তায় পড়ে গেলেন। এ রকম করলে রেকর্ডিংয়ের কী হবে? তখন তো আর ট্র্যাক রেকর্ডিংয়ের সিস্টেম ছিল না। যা হবে প্রথম থেকে শেষ একেবারে লাইভ। খুব ভাল রিহার্সাল না থাকলে যেটা সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে এই গানটি গাইছেন হিন্দি গানের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। খুবই বিরল ঘটনা। ছবির নাম "চলতি কা নাম জিন্দেগি"।  একসময় বিরক্ত হয়ে রফিসাব বললেন, “কিশোর গানটা ঝুলিয়ে দেবে। রিহার্সাল ছাড়া এ গান হয় নাকি?” মিউজিক ডিরেক্টরকে নালিশ জানিয়ে কোনো লাভ নেই, কারণ সুরকারের নামও কিশোর কুমার। রেকর্ডিংয়ের দিন যথাসময়ে কিশোর কুমার উপস্থিত। কোনও টেনশন নেই। হাসিমুখে সবার সঙ্গে মজা করছেন। যত টেনশন বাকি দু’জনের। ভাল ভাবে রেকর্ডিং হয়ে গেল ‘বন্ধ মুঠি লাখ কি।’ মান্না দে ও মহম্মদ রফি মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন, কী গানটাই না গাইলেন কিশোর কুমার! মনে মনে তাঁরা একটা কথাই ভাবছেন, বিনা রিহার্সালে এমন গান গাওয়া কেবল কিশোরের পক্ষেই সম্ভব!

সলিল চৌধুরীর সঙ্গীত পরিচালনায় "হাফ টিকিট" ছবিতে অনায়াসে গেয়েছেন নারী ও পুরুষ, দ্বৈত ভূমিকার কণ্ঠে। খামখেয়ালি আচরণ ছিল কিশোর কুমারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর বাড়ির সামনে একটা  বোর্ড লাগানো ছিল। সেখানে ইংরেজিতে লেখা থাকত "BEWARE OF KISHORE KUMAR", অর্থাৎ "কিশোর কুমার হইতে সাবধান"।

মুম্বই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে রাজেশ খন্না, জিতেন্দ্র, দেব আনন্দ, অমিতাভ বচ্চনের কণ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন কিশোর কুমার।

মজার ঘটনা ঘটেছিল "পড়োশন" ছবির সেই বিখ্যাত গান "এক চতুর নার করকে শৃঙ্গার"-এর রেকর্ডিংয়ে। সব কিছু ঠিকঠাক। রেকর্ডিংয়ের আগের দিন কিশোর কুমার বেঁকে বসলেন, এই গান তিনি কিছুতেই গাইবেন না। মান্না দে-র সঙ্গে ডুয়েট গান। মান্না দে খুব চেপে ধরতে বললেন, “কী করে গাইব বলুন তো? আমি কি আপনার মতো ক্ল্যাসিকাল জানি? পঞ্চম (রাহুল দেব বর্মণ) ঢেলে সব কাজকর্ম করে দিয়েছে! তা ছাড়া কেমন যেন  শুনছিলাম, কম্পিটিশনে আমি হেরে যাব!” তারপর আবার কিশোরকুমার জিভ কেটে বললেন, “আপনার কাছে হারতে আমার আপত্তি নেই মান্নাদা!”  মান্না দে এই গানের প্রসঙ্গ উঠলেই বলতেন, “কি গানটাই না গাইল কিশোর! এমন ইম্প্রোভাইস করল ভাবাই যায় না!"...

কিশোর কুমার সম্পর্কে কথা হলেই মান্না দে বলতেন, “এমন সুরেলা গায়ক আমি কখনও দেখিনি। আমরা নিজের অজান্তে একটু-আধটু বেসুরো ফেলেছি, কিশোর কখনও নয়।”....

 

বাংলা গানের চিরকালীন জনপ্রিয় যত অ্যালবাম আছে তার মধ্যে অন্যতম কিশোর কুমারের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত। এর যন্ত্রসঙ্গীত আয়োজনে ছিলেন আর এক কৃতি বাঙালি বাবলু চক্রবর্তী। তবলায় গুনী তবলাবাদক ইন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। স্টুডিও মুম্বইয়ের ওয়ার্লির রেডিও জেমস। ট্রেনার হিসেবে কলকাতা থেকে গিয়েছেন সমরেশ রায়। কিশোরদা খুব সিরিয়াস। বার বার বলে দিয়েছেন, স্টুডিয়োতে কেউ যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে না আসে। সমরেশবাবুর কথা খুব মন দিয়ে শুনছেন। তাঁকে ডাকতেন ‘সমরেশদা মাস্টারমশাই’ বলে।

রেকর্ডিংয়ের সময় বার বার জিজ্ঞাসা করছেন, “মাস্টারমশাই ঠিক আছে তো?” উত্তর: “হ্যাঁ হ্যাঁ।” কিশোর কুমার বিনয়ী: “না, ভাল করে শুনে বলুন।” “আচ্ছা, ওই জায়গাটা একটু ভাসিয়ে গাওয়া যায়?” সমরেশ বাবু বললেন, ‘‘যায়।’’ একটা পাতায় কী সব লিখলেন। দেখা গেল, একটা গান তৈরি হতে হতে পাতাটাও আঁকিবুঁকিতে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে।

 আর কৌতূহল দমন করতে পারলেন না ইন্দ্রনাথ বাবু। এক সময় সুযোগ পেয়ে গানের কাগজটায় দেখলেন, নানা কারুকার্যের মধ্যে একটা পাখির ছবি আঁকা। ‘‘কিশোরদা, এই পাখির ছবিটা কেন?” কিশোরদা হো হো করে হাসতে হাসতে বললেন, “আরে, ওটা এমনি পাখি নয়, ওটা কোকিলের ছবি। মাস্টারমশাই বলেছেন, ওই জায়গাটা মিষ্টি করে গাইতে, তাই কোকিলের ছবি একে রেখেছি!"...

সঙ্গীতের এই বিস্ময় প্রতিভা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন আজ থেকে তেত্রিশ বছর আগে, মাত্র আটান্ন বছর বয়সে, ১৩ই অক্টোবর ১৯৮৭তে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...