সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবন মানেই থোড়-বড়ি-খাড়া , খাড়া-বড়ি-থোড়। সেই জীবনে আলোড়ন নিয়ে আসে রহস্য-রোমাঞ্চ। আর সেই রহস্য ভেদ করতে পারার অপার্থিব আনন্দের জুড়ি মেলা ভার। রহস্য ভেদ করার মূল অস্ত্র মস্তিষ্কের সেই উচ্চপর্যায়ে চিন্তাভাবনা করার শক্তি সকলের থাকে না। যাঁদের থাকে তারা প্রণম্য। কিন্তু বাঙালি যেটা পারে সেটা হল সেই গোয়েন্দা সাহিত্যের পাতা উল্টাতে উল্টাতে সাদা কালো অক্ষরে নিজেকে মিশিয়ে দিতে। আর তার সাধের গোয়েন্দাদের সঙ্গে কল্পনার রাজ্যে রহস্যের সমাধান করে বেড়াতে। অবশ্যই গল্পের সেই শেষ পাতা পর্যন্ত যেখানে স্রষ্টা বা লেখক রহস্যের সমাধান করে দেয় নি। তাই গোয়েন্দা চরিত্র মানে সেই দূরের কালপুরুষ যাকে সাধারন বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সবসময় ছোঁয়া যায় না। কিন্তু যে গোয়েন্দা চরিত্র একেবারে সাধারণের ভিড়ে মিশে থাকে অথচ মালিন্য মুক্ত উজ্জ্বলতায় ম্লান হয়না তার বুদ্ধিমত্তা তিনি কিরীটী রায়। কিরীটী রায়ের স্রষ্টা ডক্টর নীহাররঞ্জন গুপ্ত। মূলত আগাথা ক্রিস্টির গোয়েন্দা সাহিত্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই তিনি সৃষ্টি করেছিলেন এই চরিত্রটি। কিরীটি রায়ের আবির্ভাব "কালো ভ্রমর" উপন্যাসে। ১৯৩০ সালে প্রথম আবির্ভাবে এই গোয়েন্দা চরিত্রের। তবে এটি পূর্ণাঙ্গ বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। তাঁর বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক বলেছেন "প্রায় সাড়ে ছয় ফুট লম্বা, গৌরবর্ণ, বলিষ্ঠ চেহারা। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল। ব্যাকব্রাশ করা। চোখে পুরু লেন্সের কাল সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমা। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। মুখে হাসি যেন লেগেই আছে। সদানন্দ, আমুদে"। ঠিক যেন আমাদের খুব কাছের মানুষ একজন। যাঁর হাতে নির্ভরতায় ছেড়ে দেওয়া যায় সমস্ত রহস্যের ভার।
কলেজ জীবনে শখের তাড়নায় রহস্যভেদেই তার নেশার শুরু। পরে তা পেশায় পরিণত হয় সুযোগ্য সহযোগী সুব্রত রায়কে সঙ্গে নিয়ে। কিছু গল্পে সুব্রত রায় কথক, কিছু কাহিনী আবার স্বয়ং গোয়েন্দার মুখেই বর্ণিত হয়েছে। টানটান, উত্তেজনায় ভরা রহস্য সমাধানের সূত্র খুঁজে বেড়িয়েছেন গোয়েন্দা। আর খুব সাধারন বিষয় যা স্বাভাবিকভাবে নজরে আসে না সেখানেই লুকিয়ে থেকেছে রহস্যের জট খোলার একের পরে এক ক্লু। বয়ঃসন্ধিকাল থেকে রহস্য অনুসন্ধান করা এই গোয়েন্দা কিশোর মনের নায়ক। তবে তাঁর রহস্যভেদের জাদু মোহাচ্ছন্ন করেছে যে কোন বয়সের পাঠককে। মধ্যবিত্ত জীবনে রহস্য-রোমাঞ্চের থেকে প্রতিদিনের জীবনচর্যার সংঘাতই প্রধান স্থান দখল করে থাকে। এই কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্র যেন পক্ষীরাজ ঘোড়া যা পাঠককে উড়িয়ে নিয়ে যায় রহস্যে ভরা রঙিন জগতে। সেই জগতে অন্ধকার থাকলেও অন্ধকারের শেষে রামধনুর মতো আলো ঝিলমিল করে পাঠক মনকে আলোকিত করে রহস্য সমাধানের মাধ্যমে। ফলে সাময়িক মুক্তি মেলে জীবনচর্যার গ্লানি থেকে। কিরীটীর গল্পগুলোতে স্বয়ং গোয়েন্দারও বুক ঢিব-ঢিব করেছে পাঠকের মতই। গোয়েন্দা সাহিত্য সাধারণ মধ্যবিত্ত কল্পনাপ্রবণ বাঙালির কাছে বড় প্রিয়। বড় আদরের।
কিরীটি রায়ের "কালো ভ্রমর" উপন্যাসে দুর্বৃত্ত দস্যু কালো ভ্রমরও পাঠকের মনে সমানভাবে জায়গা করে নিয়েছে স্বয়ং গোয়েন্দার সঙ্গে। নায়কের সঙ্গে খলনায়কও পাঠকের মনে জায়গা করে নেয় এমন দৃষ্টান্ত সাহিত্যে কমই দেখার সুযোগ হয়। কিরিটি পত্নী কৃষ্ণা রায় বুদ্ধিমতী পার্সী মহিলা। স্বামীর রহস্য সন্ধানে বরাবর আগ্রহ প্রকাশ করেছে। "কালো ভ্রমর" উপন্যাসে তাঁরা পরস্পরের প্রেমে পড়লেও "হলুদ শয়তান" গল্পে সম্পন্ন হয়েছে তাঁদের বিয়ে। গল্প, উপন্যাস মিলিয়ে মোট ৮০টি সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে কিরীটী রায়-কে ঘিরে। কয়েকটা গল্প, উপন্যাস নিয়ে সিনেমা হলেও ফেলুদা, ব্যোমকেশের মত জনপ্রিয় হয়নি চিত্রনাট্যগুলো। তাই এই গোয়েন্দাকে জানতে গেলে কাগজের উপর সাদা কালো অক্ষরই একমাত্র উপায়। গোয়েন্দা গল্পের প্রাণ তার মধ্যে সৃষ্টি হওয়া সাসপেন্স বা কৌতুহল বাঁচিয়ে রাখার ক্ষমতা যা ডক্টর নীহাররঞ্জন গুপ্ত তাঁর সৃষ্টিতে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে রক্ষা করেছেন। আর বাঙালি নিজেদের ভিড়েই প্রখর বুদ্ধিধারী এই গোয়েন্দা চরিত্রকে উপহার হিসেবে পেয়েছে।