বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের বেতাজ বাদশা নরেন্দ্রনাথ মিত্র

নরেন্দ্রনাথ মিত্র, বাংলা সাহিত্যের দিকপাল এই কিংবদন্তি সাহিত্যের প্রতিক্ষেত্রেই অবাধ বিচরণ করেছেন। বিশ্বযুদ্ধত্তর যুগের অন্যতম সাহিত্য স্রষ্টা বলতেই তাঁর নাম মনে পড়ে, ১৯১৬ সালের ৩০শে জানুয়ারি অর্থাৎ আজকের দিনেই ওপার বাংলার ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত সদরদি ভাঙা গ্রামে নরেন্দ্রনাথের জন্ম হয়। পিতা, মহেন্দ্রনাথ, মা বিরাজবালা। নরেন্দ্রনাথ শৈশবেই মাতৃহারা হন। জগমোহিনীর আশ্রয়ে ও স্নেহে পন্টুর বেড়ে ওঠা। পিতা উকিলের সেরেস্তায় মুহুরী হলেও, গানে-অভিনয়ে-কাব্য উপন্যাস পাঠে এবং চিঠিপত্র লেখায় ছিলেন পারদর্শী।

সেই গুন রপ্ত করেছি পন্টু। একান্নবর্তী পরিবার আর দারিদ্র পন্টুকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিচ্ছিল। লেখাপড়া গ্রামের অক্ষয় মাস্টারের কাছে, তারপর এম. ই. স্কুলে। পরবর্তী পর্যায়ে পন্টুর পরিবারের নিশ্চিন্ত নিরাপদ জীবনের অবসান হয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বাংলা তখন বিধ্বস্ত, দেশ দ্বিখণ্ডিত। পূর্ববঙ্গবাসীদের জীবন তখন বিপন্ন তারা সকলেই প্রায় ছিন্নমূল। ওদিকে পিতার মৃত্যুর ফলে সংসার আর্থিক দুর্গতির সম্মুখীন হয়।

সেই সময় ন্যাশানাল ব্যাঙ্কে চাকরি নিয়ে পন্টুর কলকাতায় আগমন হয়। কিছুদিনের জন্য ব্যাঙ্কের জব্বলপুর শাখায় বদলি, পরে পুনরায় কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করেন। একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর অন্যদিকে সম্প্রদায়িক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় বিপর্যস্ত কলকাতা। ভাই ধীরেন্দ্রনাথকে নিয়ে ৭/১, ব্রজদুলাল স্ট্রীটে এক সঙ্কীর্ণ গৃহে আশ্রয় নিল পন্টু। এই পরিবেশেই শুরু হল সাহিত্যসাধনা। প্রকাশিত হল প্রথম উপন্যাস দ্বীপপুঞ্জ। প্রথম উপন্যাস হরিবংশ নামে ১৯৪২-এ দেশ পত্রিকায় মুদ্রিত হয়, পরে ১৯৪৬ সালে দ্বীপপুঞ্জ নামে পরিবর্তিত হয়। যদিও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস হল রূপমঞ্জরি। হ্যাঁ, পন্টুই আমাদের মাতৃভাষার অন্যতম সেরা কলমের অধিকারী নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ডাক নাম।

নরেন্দ্রনাথ মিত্রের পারিবারিক আবহ ছিল শিল্প-সাহিত্যের অনুকূল। বাবা ছিলেন তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির প্রেরণাশক্তি। স্মৃতিচারণে বাবা সম্পর্কে তার মন্তব্য হচ্ছে— ‘শুধু সাহিত্যপ্রীতি, শুধু যৎসামান্য লেখার শক্তি। শুধু নিজের যন্ত্রণাকে ভাষায় ব্যক্ত করার কথঞ্চিত ক্ষমতা। এই আমার উত্তরাধিকার।’ খুব ছোট্টবেলায় তাঁর লেখক জীবন শুরু হয়েছিল। নবম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন সহপাঠীদের সঙ্গে নিয়ে ‘আহ্বান’ নামের একটি পত্রিকা বের করতেন। সেখানে তিনি ‘মুক্তার হার’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। পরবর্তী বহু খুঁজেও সেই উপন্যাসটি তিনি আর পাননি। তারও আগে অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন তিনি ডায়রিতে পারিবাবরিক ইতিবৃত্ত লিখেছিলেন।

নরেন্দ্রনাথ ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে অস্থায়ী পদে ‘কৃষক’, ‘স্বরাজ’, ‘সত্যযুগ’, ‘মন্দিরা’ ইত্যাদি পত্রিকায় চাকরি করেন। শেষে ১৯৫২ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় স্থায়ী পদে যোগ দেন। কর্মসূত্রে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সাহিত্যিক বিমল কর, সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ এবং শাস্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। নরেন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবন ছিল স্বতন্ত্র। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী কলম ধরেননি। উল্টোরথ পত্রিকার জন্য লেখক শ্রীকিরণকুমার রায়ের নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এবং চিঠিতে তাঁর লেখক হওয়ার ইতিহাস জানা যায়।

তাঁর নিজের কথাতেই “কি করে লেখক হলাম, কেন লেখক হলাম তা এক কথা তো ভালো, একশ কথাতেও বলা যায় কিনা সন্দেহ। আমরা সাধারণ লোক সাধারণ লেখক সবসময় সচেতনভাবে বিশেষ একটা পরিকল্পনা নিয়ে কিছু হয়ে উঠিনে, কি কিছু করে বসিনে। কিছু হওয়ার পরে সেই হওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করতে বসি। সব লেখকই আদিতে পাঠক, আমিও তাই ছিলাম। ছেলেবেলা থেকে বই পড়তে ভালোবাসতাম। বই যে লাইব্রেরী থেকে সংগ্রহ করতে হয় অল্প বয়সে আমার সে ধারণা ছিল না, বইয়ের জন্য পাড়ার সদ্য বিবাহিতা বউদিদের কাছে হাত পাততাম। পাঠক হিসেবে মেয়েদের সঙ্গে সেই যে আমার গোপন আত্মীয়তা হয়েছিল আজ লেখক হিসেবেও প্রায় তাই আছে। গভর্নমেন্ট অফ্ দি পিপল্, বাই দি পিপল, এ্যান্ড ফর দি পিপল-এর মত আমি মেয়েদের নিয়ে লিখি, মেয়েদের হয়ে লিখি, মেয়েদের জন্য লিখি। একথা বলতে আমার লজ্জা নেই। পুরুষ পাঠক যদি দু’ একজন মেলে তাকে ভাগ্য বলে মানি”

একাধিকবার বাড়ি বদলের দুর্ভোগও নরেন্দ্রনাথকে ভোগ করতে হয়েছিল। যেমন দ্বিতীয়বার সপরিবারে আশ্রয় নেন ১১৯বি, নারকেলডাঙ্গা মেন রোডের ব্রজদুলাল স্ট্রীটে একটি দেড়খানা ঘরে আটজন একত্রে, তারপর ৯৮, লিন্টন স্ট্রীটের এক বস্তি বাড়িতে, শেষে ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে ২০/১/এ, রাজা মণীন্দ্র রোডের এক বড় বাড়িতে। ছোটগল্পকার হিসেবে সুবিদিত হলেও নরেন্দ্রনাথের আত্মপ্রকাশ কিন্তু কবি রূপে।

‘তোমাকে বাসি ভাল একথা ক্ষণে ক্ষণে
বলিব তোমা ভাবি সদাই মনে মনে
বলিতে যবে যাই কথা না খুঁজে পাই
হতাশ হয়ে ফিরি আপন গৃহকোণে’।

‘মূক’ নামের মোট ষোলো লাইনের এই কবিতাটি প্রকাশ পেল। কবির নাম নরেন্দ্রনাথ মিত্র। বউবাজারের বাড়িতেই এই বিশেষ গুণের আত্মপ্রকাশ, প্রথম লেখা ছাপা হল। কবিতার নাম ‘মূক’। দেশ পত্রিকার শ্রাবণ ১৩৪৩ সন। দেশ পত্রিকাতেই তার প্রথম গল্প ‘মৃত্যু ও জীবন’ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই তিনি ধারাবাহিকভাবে গল্প-উপন্যাস লিখে গিয়েছেন। ১৯৩৯ সালে ‘জোনাকি’ নামের তিনজনের একটি যৌথ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের সঙ্গে অন্য দুজন লেখক ছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এবং বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য। তারপর ১৯৩৬-১৯৩৭ সালের মধ্যে ‘দেশ’-এ চারটি গল্প, ‘প্রবাসী-বিচিত্রা-বঙ্গশ্রী-পরিচয়’-এ চারটি গল্প প্রকাশিত হয়।

তারপর মাঠকোঠায় একের পর এক লেখা। পরোক্ষ প্রকাশিত হল আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়তে ১৩ এপ্রিল ১৯৪১, দেবব্রত-পারুলের না বলা প্রেম। নরেন্দ্রনাথের প্রথম দিকের গল্প, কবিতায় প্রথম প্রেম নিদারুণ ঝরে পড়ল।

‘নিরিবিলি’ নামে নিজের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করলেন নরেন্দ্রনাথ। আর সেই বই নিয়ে ‘কবিতা’ পত্রিকায় স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু লিখলেন, ‘‘শ্রী নরেন্দ্রনাথ মিত্রের পাঠকসংখ্যা আজ বিপুল, কিন্তু এ-বইখানা পড়ে (বা দেখে) আজকের দিনে কম পাঠকেরই সন্দেহ হবে যে এর প্রণেতা ও তাঁদের প্রিয় কথাশিল্পী একই ব্যক্তি।’’ প্রথম থেকেই নরেন্দ্রনাথকে কবিতা লেখার জন্য উৎসাহ দিতেন বুদ্ধদেব বসু। ‘কবিতা’ পত্রিকায় অনেক কবিতা ছাপিয়েছিলেন তিনি। নরেন্দ্রনাথ মিত্র হলেও ছোটগল্পের বেতাজ বাদশা।তিনি স্বতন্ত্র, এক কথায় তিনি ছিলেন বাংলা ছোটগল্পের সুনিপুণ কারিগর। তিনি মোট ৩৮টি উপন্যাস এবং ৫১টি ছোটগল্প গ্রন্থ রচনা করেছেন। রচনায় বিশ্ব প্রেক্ষাপট কিংবা দেশীয় রাজনীতির বদলে মানবমনে ক্রিয়াশীল অনুভূতিকেই বুনে গিয়েছেন। প্রেম এবং সামাজিক আলেখ্যকে কেন্দ্র করেই তাঁর ছোটগল্পের বিষয় বিন্যস্ত হয়েছে।

তাঁর ছোটগল্পের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে প্রেম। তার মধ্যেও বৈচিত্র্য রয়েছে। অবিবাহিত নর-নারীর প্রেম, অসম বয়সীদের প্রেম, পরকীয়া প্রেম এবং বিধবা রমণীদের প্রেম স্থান পেয়েছে প্রেমপ্রধান ছোটগল্পগুলোতে। সামাজিক কাহিনী নির্ভর ছোটগল্পগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সমস্যা, সামাজিক সমস্যা প্রধান্য পেয়েছে। প্রত্যক্ষ করা সমাজ থেকে তুলে এনেছেন সামাজিক ছোটগল্পগুলোর বিষয়বস্তু। জীবনের কদর্য রূপটিকে ফুটিয়ে তোলার চেয়ে জীবনের ইতিবাচক দিকটিকে রূপায়ণ করতেই তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। জীবনের শুভ দিকের উন্মোচনের মধ্যে দিয়ে গল্পের ব্যাঞ্জনাময় সমাপ্তি করতেন তিনি।

অবিবাহিত নর-নারীর প্রেম নিয়ে লেখা তাঁর গল্পগুলো হল, দীপান্বিতা, একটি নাগরিক প্রেমর উপাখ্যান, আরোগ্য প্রভৃতি। অসমবয়সীদের প্রেম নিয়ে লেখা গল্পগুলোর মধ্যে পুনরুক্তি, অভিসার, একটি ফুলকে ঘিরে, কোন দেবতাকে ইত্যদি উল্লেখযোগ্য। পরকীয়া প্রেমের গল্পগুলোর মধ্যে পুরুষ, একূল-ওকূল, কুলফি বরফ, রস, সুহাসিনী, তরল আলতা উল্লেখ্য।নিম্নবিত্ত-বিত্তহীনদের সংকট নিয়ে লেখা গল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে চোর, চাঁদমিঞা, আবরণ, কাঠগোলাপ, অভিনেত্রী, একপো দুধ, সম্ভ্রম প্রভৃতি।

সামাজিক সমস্যা নিয়ে রচিত তার গল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে, স্বখাত, রোগ, রসাভাস, সেতার, রত্নাবাঈ, বিদ্যুত্লতা প্রভৃতি। পতাকা, শোক, অপঘাত, রাজপুরুষ ইত্যাদি তাঁর রাজনীতি নিয়ে লেখা গল্পগুলির মধ্যে উল্লেখ করতে হয়। নরেন্দ্রনাথ মিত্র ‘গল্প লেখার গল্প’ শীর্ষক ভূমিকায় বলেছেন- "কিন্তু পিছন ফিরে তাকিয়ে বই না পড়ে যতদূর মনে পড়ে আমি দেখতে পাই ঘৃণা বিদ্বেষ ব্যঙ্গ বিদ্রূপ বৈরিতা আমাকে লেখায় প্রবৃত্ত করেনি। বরং বিপরীত দিকের প্রীতি, প্রেম, সৌহার্দ্য, স্নেহ, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, পারিবারিক গণ্ডির ভিতরে ও বাইরে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচিত্র সম্পর্ক, একের সঙ্গে অন্যের মিলিত হওয়ার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা বার বার আমার গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে। তাতে পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। তা জেনেও আমি আমার সীমার বাইরে যেতে পারিনি।"

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর গল্পকার জীবনের শুরুয়াৎ এবং যুদ্ধ-পরবর্তী সময়েই তার পরিব্যাপ্তি। নরেন্দ্রনাথ মিত্র চারশতাধিক ছোটগল্প রচনা করেছেন। ছোটগল্পগুলোর মধ্যে ‘রস’, ‘পালঙ্ক’ ‘হেডমাস্টার’ গল্পের চলচ্চিত্রায়ণ হয়েছে। ‘রস’ সওদাগর নামে হিন্দিতে ছবি হয়েছে। অমিতাভ বচ্চন অভিনয় করছিলেন। সপরিবার সে ছবি দেখতে গিয়েছিলেন নরেন্দ্রনাথ। অগ্রগামীর ‘বিলম্বিত লয়’ ছবির চিত্রনাট্যও লিখেছিলেন।

উত্তমকুমারও তাঁর গল্প নিয়ে ছবি করতে চেয়েছিলেন। আর এক জন মানুষও তাঁর গল্প নিয়ে ছবি করে আগ্রহ করেছিলেন। তিনি সত্যজিৎ রায়। ‘মহানগর’ উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ করেছেন সত্যজিৎ রায়। তাঁর গল্প নাটক রূপেও মঞ্চস্ত হয়েছে। তাঁর অনেক গল্প ফরাসি, হিন্দি, মারাঠি, রুশ, ইংরেজি, ইতালিয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। নরেন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাসগুলি খ্যাত-স্বল্পখ্যাত বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, যেমন দেশ প্রবাসী বিচিত্রা বঙ্গশ্রী-পরিচয়-জনসেবক-গণবার্তা ইদানীং চতুষ্কোণ চতুরঙ্গ মানসী ভারতবর্ষ, বসুধারা, বসুমতী, সত্যযুগ, আনন্দবাজার পত্রিকা, বেতার জগৎ প্রভৃতি। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন।

মেসজীবন, একাধিক বাসাবদল, যুদ্ধ, দাঙ্গা, দেশবিভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা ইত্যাদি ঘটনাসমূহের অভিজ্ঞতায় পূর্ণ হয় নরেন্দ্রনাথের লেখকজীবন। স্বভাবতই সংখ্যাধিক্যে এবং বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হয় তাঁর সাহিত্যজগৎ। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ভাষা খুবই সহজ-সরল এবং সুখপাঠ্য। গল্পপাঠে পাঠকের ক্লান্তি আসে না। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ভাষার এই সাবলীলতা-প্রাঞ্জলতা তাঁর গল্পের প্রাণ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন— "নরেন্দ্রনাথ মিত্রকে অনেকবার দেখার সুযোগ পেয়েছি এবং একটা ব্যাপার ভাবতে খুব অবাক লাগত যে, এত সুন্দর সহজ-সরল ভাষায় উনি কীভাবে গদ্য লিখতেন। গদ্য মানেই আমরা ভাবতাম কঠিন ভাষা, ভাষার মারপ্যাঁচ ইত্যাদির প্রয়োজন হয় বুঝি। কিন্তু ওর গদ্যের ভাষা ছিল ব্যতিক্রম।"

তাঁর গল্পে দেশবিভাগ-দাঙ্গা-মন্বন্তর-যুদ্ধোত্তর বিপর্যস্ত অর্থনীতি- সবকিছুই উঠে এসেছে। সদর্থক কাহিনীকার। জীবন সুখ দুঃখের সমাহার। তিনি সেই জীবনের গল্প বলেছেন, সহজ সরল প্রাঞ্জল ভাষায়। তাঁর জীবনটাই তো এমন। তাঁর আবেগই তাঁর গল্পের শক্তি, তাঁর জীবনের রসদ। গ্রামের ছেলে তো, উদারতাটা ওখান থেকেই পেয়েছিল। নরেন্দ্রনাথের ছেলের কথায় জানা যায়, নমঃশূদ্রদের পাড়ায়, জেলেদের অঞ্চলে চলে যেতেন তাঁর বাবা। ওঁদের সঙ্গে সময় কাটাতেন। বরং নামী ব্যক্তির সঙ্গ এড়িয়ে চলতেন।

খুব যে বাইরে ঘুরেছেন এমনও নয়, অন্দরের মানুষ, আশপাশের মানুষ ছিলেন তাঁর গল্পের লোকজন। এক পোস্টম্যান তাঁর বাবার কাছে আসতেন। তাঁর অসম্ভব সাহিত্যপ্রীতি, সেই দেখে নরেন্দ্রনাথ তাঁকে সাহিত্য পাঠে উৎসাহ দিতেন। একজন চর্মকার ছিলেন তাঁর খুব প্রিয়। এমন অনেক দিন হয়েছে নরেন্দ্রনাথ পাশে বসে ওঁর জীবনের নানা গল্প শুনেছেন। ​মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর শ্মশানে সাহিত্যিক হিসেবে একমাত্র তিনি উপস্থিত ছিলেন। বড় সংগ্রাম করে তাঁর দিন যাপন হয়েছে, একই ঘরের মধ্যে দুই উঠতি সাহিত্যিক গল্প লিখেছেন। ঘরে চেয়ার-টেবিলের কোনও বালাই নেই। দুজনেই যে যার তক্তপোশে।

একজন উপুড় হয়ে শুয়ে নিঃশব্দে লিখছেন, আর অন্যজন বাবু হয়ে বসে সামনে টিনের বাক্স রেখে তার ওপর খাতা রেখে কলম চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রথম জন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় আর দ্বিতীয় জন নরেন্দ্রনাথ। তখন শোভাবাজারের এক মেসে একটি ঘরে পাঁচ জন। নরেন্দ্রনাথ, ভাই ধীরেন্দ্রনাথ, বন্ধু নারায়ণ আর বাকি দুই বোর্ডার গেঞ্জিকলের শ্রমিক। মাথাপিছু মাসিক ভাড়া দু’ টাকা। কলকাতার কলেজে পড়াবেন বলে ভাইকে নিয়ে এসেছিলেন। আয় বলতে মাত্র দুটি টিউশনির টাকা। নিজেরই চলে না। তবুও ভাইকে কিছুতেই মফস্বলের কলেজে বি এ পড়াবেন না। ভাইকে ডেকে নিয়েছিলেন।

মেসে খাওয়াদাওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই। টানাটানির সংসারে পাইস হোটেলে দু’আনায় দু’বেলা ডিমভাত খেয়ে দিনের পর দিন চলত। তবে নারায়ণ কিংবা নরেন্দ্র যারই গল্প লেখার টাকা যে দিন আসত, সে দিন এক এলাহি ব্যাপার। তিন জনে মিলে ‘রূপবাণী’ রেস্তোরাঁয় ফাউল কাটলেট আর টকি শো হাউজে তিন আনার সিটে গ্যারি কুপারের ছবি।

পরে ছোটভাই ধীরেন্দ্রনাথও বিয়ে করে সস্ত্রীক দাদার সঙ্গে থাকে। কখনও বস্তিতে টালির ঘর, তো কখনও দেড়খানা কোঠাঘরে, সবাই মিলে। সে ঘর আবার এমন ছোট যে, ছোট একটা খাট পাতলেও, একটা চেয়ার রাখারও জায়গা নেই। একবার কিছু দিনের জন্য নিমতলার কাঠগুদামের কাঠের ঘরেও থাকতে হয়েছে। এমন দিনও গেছে, সংসারের খরচ মেটাতে সকাল বিকেল দুবেলা চাকরি করতে হয়েছে। তার মধ্যেও লেখা কিন্তু থামাননি। এই দিন যাপনের লেখাই তাঁকে বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকার রূপে গড়ে তুলল।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...