চল্লিশ ডিগ্রির আশেপাশে গরম। সকাল থেকে গরম হাওয়ার দাপট ধাঁধা লাগিয়ে দিচ্ছে চোখে। সকালে ঘুম থেকে উঠলে বোঝার উপায় থাকছে না সকাল সাতটা নাকি বেলা দুটো। এহেন তাতা-পোড়া অবস্থায় গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মত তখন তখন লম্বা লোডশেডিং। যে কোনওভাবে রোদ এড়িয়ে ফ্যান, এসির নীচে বসে পড়া। আর অহরহ বৃষ্টির দিনগোনা। এই হল অধুনা বাংলার ছবি। কলকাতা থেকে দার্জিলিং লোকেশন মার্ক যাই হোক না কেন মোবাইল স্ক্রিনে সিনের তাপমান একই!
এই প্রবল জ্বালাপোড়ার দিনে সুখ যেন শুধু একটা জায়গাতেই মেলে। গ্রীষ্মের ফল বাজারে। চকচকে রোদের মধ্যে ঝকঝকে সোনালী আম। সবুজ, হলুদ, লাল দেখলেই মুহূর্তে চিড়বিড়ানি গরমটা হালকা হয়ে মন মিঠে হয়ে যায়। গরমকালের এই একটি মাত্র সুখ- ‘আম’।
হু-হু দুপুরে ফ্রিজ থেকে বের করে ঠাণ্ডা আমের ফালি, রাস্তার ধারে আমের সরবত, খাওয়ার শুরুতে আম, শেষে আম- গরম মানে আমময় জীবন। শীতপাগল বাঙালির গরমকে ভালবাসার একটাই কারণ ‘আম’। সারাবছর তার জন্য অপেক্ষা। জনতা তাই ‘আম জনতা’। মুঘল সম্রাটরা পর্যন্ত নতজানু হয়েছিলেন এই ফলের কাছে।
ভারতে কীভাবে শুরু হল আমের চাষ?
‘ আ হিস্টোরিক্যাল ডিকশেনরি অফ ইন্ডিয়ান ফুড’ বইটিতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ভারতে আমচাষ শুরু হয় পর্তুগিজদের হাত ধরে। ভারতের যে অংশে প্রথম এই চাষ হয় সেটি তৎকালীন ভারতের অংশ হলেও তা বর্তমানে মায়ানমারের অংশ। প্রথম উৎপাদিত আমের নাম ছিল ফর্নান্দিন।
মুঘল আমলে স্বর্ণমূল্যে বিচার হত আমের মান। তবে শাহজাহানের আমলে এই নিয়ম বদলে যায়। ভারতে জলহাওয়া মাটি আম উৎপা নের জন্য অত্যন্ত উপযোগী, তাই বাড়তে থাকে ফলন। পাল্লা দিয়ে সাধারণের মধ্যে চাহিদাও। নানা প্রজাতির আম নিয়ে চলতে থাকে পরীক্ষা-নিরিক্ষা। নতুন নতুন নাম দেওয়া হয় আমের। বাদশাহকে আম উপহার দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। বিশেষ করে সম্রাট শাহজাহানের আম-প্রেমের কথা মুঘল অন্দর বপার হয়ে প্রজাদের মুখে মুখে ফিরত। সম্রাট আমপান্না খেতে ভালোবাসতেন। এমনকি তিনি পুত্র ঔরঙ্গজেবকেও আম খাওয়ার জন্য শাস্তি দিয়েছিলেন। জাহাঙ্গীর ও শাহজাহান দুজনেই তাদের খানসামাদের আম পান্না, আমের লাজ, আমের মিঠা পোলাও রান্নার জন্য ইনাম করতেন। ঔরঙ্গজেবও আম খেতে ভালোবাসতেন। এমনকি পারস্যের সম্রাট শাহ আব্বাস কে তিনি আম পাঠাতেন উপহার স্বরূপ।
আম ভারতের সংস্কৃতির অঙ্গ। সময় অনুসারে তাতে নানা বদলের রঙ ধরে। আমের নামেও আছে ইতিহাস। ভারতীয় বাজারে ল্যাঙড়া-ফজলি-হিমসাগর এই তিন আম সবচেয়ে পরিচিত এবং জনপ্রিয়। এছাড়াও আছে আরও নাম। আমের মতোই সুস্বাদু তার নামকরণের ইতিহাসও। শুরু করা যাক ফজলি দিয়ে...
ফজলিঃ ১৮০০ সালে মালদহ জেলার কালেক্টর র্যাভেনশ সাহেব এই আমের নামকরণ করেন ‘ফজলি’। শোনা যায় কালেক্টর সাহেব একবার ঘোর গ্রীষ্মে ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছিলেন গৌড়। কাঠফাটা গরমে তীব্র পিপাসায় পথের মধ্যে জলের খোঁজ করেন। ফজলি বিবি নামক এক প্রৌঢ়া বাস করতেন স্বাধীন সুলতানদের ধ্বংসপ্রাপ্ত গৌড়ের একটি প্রাচীন কুঠিতে। তাঁর বাড়ির উঠোনেই ছিল একটি আমগাছ। ফজলি এই গাছটির খুব যত্ন নিতেন।
কালেক্টর সাহেব ফজলি বিবির কুঠিরের কাছে শিবির স্থাপন করেন। তাঁর আগমনের খবর পেয়ে ফজলি বিবি সেই আম নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। সাহেব সেই আম খেয়ে খুবই তৃপ্ত হন। জানতে চান, সেই নামের নাম। কিন্তু ইংরেজি না বুঝে শুধু ‘নেম’ শুনেই নিজের নাম বলে দেন ফজলি বিবি। সেই থেকেই এই আমের নাম হয় ‘ফজলি’।
আরও একটি কাহিনী শোনা যায় ফজলির নাম করণ নিয়ে। সেই কাহিনীটি ঠিক একরকম, ইলিইয়াস শাহী বংশের সুলতান ইয়্যুসূফ শাহ্(১৪৭৪-১৪৮১ ঈঃ)’র অন্যতম স্ত্রীর নাম ছিল সুলতানা ফাদ্লী বিবি।
সদ্য বিয়ে হয়ে আসার পর তিনি নাকি একবার আম খেয়ে আঁটি প্রাসাদের বাগানে ফেলেছিলেন। ক্রমান্বয়ে সেই আঁটি থেকে গাছ হয় ও তাতে আমও ধরে! আশ্চর্য্যের ব্যাপার হচ্ছে-ওই গাছের আমগুলো দিন দিন আকারে বাড়ছিল আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিলেন সুলাতানাও। প্রাসাদের দাস-দাসীরা এই নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করত। তারা সুলতানার নামানুসারে আমের নামও দিয়েছিল ‘ফাদ্লী’। একদিন এটা সুলতানার কানেও গেল। সুলতানা গেলেন রেগে। সুলতানের কাছে নালিশও দিলেন এ নিয়ে।
বেজায় কৌতুহল হল সুলতানের। যাচাই করে দেখেন যে- দাসীদের কথাই ঠিক! তাদের রসবোধ দেখে খুব হাসলেন সুলতান। ঐ আম খুব ভালো জাতের বুঝে তার আরও চারা লাগানোর ব্যবস্থা করলেন।
সেই থেকে গৌড়ের প্রাসাদে জন্ম নেওয়া এই আম প্রাসাদ থেকে ছড়িয়ে পড়ল দূর দূরান্তে। ছড়িয়ে পড়ে এর নামও! তবে কালক্রমে ফাদ্লীফাযলী ও পরে আরও বিকৃত হয়ে ফজলীতে পরিণত হল।
ল্যাংড়াঃ মুঘল আমলে দ্বারভাঙায় এই প্রকারের আম চাষ শুরু হয়। কিন্তু তখন কেউ এর নাম নিয়ে মাথা ঘামায়নি। পরে আঠারো শতকে এক ফকির খুব সুস্বাদু এই আমের চাষ করেন। সেই ফকিরের পায়ে কিছু সমস্যা ছিল। খুঁড়িয়ে চলতেন। সেই থেকেই আমের নাম হয়ে যায় ‘ল্যাংড়া’।
হিমসাগরঃ হিমসাগরকে বলা হয় আমের রাজা। অন্য সব আমের থেকে হিমসাগরের স্বাদ-গন্ধ আলাদা। শাঁসের বাহুল্য থাকলেও আঁশের বাহুল্য থাকে না। আর দুরন্ত স্বাদ। হিমসাগরের জনপ্রিয়তার কারণ।
লক্ষ্মণভোগ ও গোপালভোগ: ইংরেজবাজারের চণ্ডীপুরের বাসিন্দা লক্ষ্মণ একটি আম চারা বসিয়েছিলেন। সেই গাছে আম যখন ধরল তখন তার স্বাদে-গন্ধে সাড়া পড়ে গেল চারপাশে। লক্ষ্মণ চাষির নাম থেকেই লক্ষ্মণভোগ আমের উৎপত্তি। ইংরেজবাজারে নরহাট্টার গোপাল চাষির নামে নাম হয় গোপালভোগের।
গোলাপখাসঃ সবুজ আর লালের আভায় টুকটুকে এই আম বাজারে নজর কেড়ে নেয়। মিষ্টি গোলাপের গন্ধ মতো গন্ধ। তাই এই আমের নাম ‘গোলাপখাস’। প্রাচীন বাংলার আমগুলির মধ্যে গোলাপখাস অন্যতম।
আম্রপালিঃ গৌতম বুদ্ধের প্রথমা শিষ্যা ছিলেন আম্রপালি। আম্রপালিকে শৈশবে তার পালক পিতা একটি আম গাছের তলায় কুড়িয়ে পান। তাই তাঁর নাম হয়েছিল আম্রপালি। নগরবধূ আম্রপালি ভারতের সর্বকালের সর্বসেরা সুন্দরী নর্তকী হিসেবে খ্যাত। পরবর্তীকালে গৌতম বুদ্ধের শরণে আসেন। তাঁর নামানুসারেই বিজ্ঞানীরা শংকর প্রজাতির একটি আমের নাম দেন আম্রপালি।
মির্জা পসন্দঃ মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত আম। নবাব নাজিম ফেরাদুন জাঁ মির্জা পদাধিকারী এক কর্মীর সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক করে আমের বাগান করেন। সেই থেকে আমের নাম হয় মির্জা পসন্দ। তবে এখন এই আম বিরল।
চৌসাঃ ১৫৩৯ সালে শের শাহ সুরি বিহারের চৌসার যুদ্ধে হুমায়ুনকে পরাজিত করেন। জয় উদযাপন করতে তিনি আমের নাম রাখেন চৌসা। অনেকে অবশ্য বলেন চুষে চুষে খাওয়া হয় বলে এই আমের নাম নাম চৌসা।