একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি

আঠারো বছর বয়স স্পর্ধার বয়স। এই বয়সেই ডাক দেয় দুঃসাহস। ঝুঁকি নেওয়ার। সেই ডাকে কেউ সাড়া দেয়, আর কেউ পারেনা। কিন্তু তিনি পেরেছিলেন। সবে কৈশোর পেরিয়ে আসা এক ছেলেকে দেখতে লোকে লোকারণ্য।

সমস্তিপুরের পুসা রেলস্টেশন। ভিড় সামলাতে হিমশিম ইংরেজ প্রভুর পুলিশ। সে খবর বেরিয়েছিল ইংরেজি স্টেটসম্যান পত্রিকার পাতায়। লেখা হল, দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, "একটা ছেলেকে দেখার জন্য রেল স্টেশনে ভিড় জমে গিয়েছিল...” চারণ কবি গান বেঁধেছিল তার জন্য।


“একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।
হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী।
কলের বোমা তৈরি করে
দাঁড়িয়ে ছিলেম রাস্তার ধারে মাগো,
বড়লাটকে মারতে গিয়ে
মারলাম আরেক ইংলন্ডবাসী।
হাতে যদি থাকতো ছোরা
তোর ক্ষুদি কি পড়তো ধরা, মাগো
রক্ত-মাংসে এক করিতাম
দেখতো জগতবাসী”

সদ্য আঠারো ছোঁয়া সেই ছেলে গোটা দেশকে দেখিয়ে দিয়েছিল বীর কাকে বলে! কাকে বলে দেশকে ভালোবাসা! সেই অবাক কিশোরের নাম ক্ষুদিরাম বসু। পশ্চিম মেদিনীপুরের হাবিবপুরের ভূমিপুত্র। বাবা ত্রৈলোক্যনাথ বসু ছিলেন নাড়াজোলের তহসিলদার। মা লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী।

মাত্র পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারাতে হয়েছিল। ঠিক একবছর পর বাবা। নিঃসন্তান দিদি অপরুপা শিশু-সহদোরকে নিয়ে গেলেন দাসপুরে। নিজের কাছে। সন্তান স্নেহে মানুষ করতে লাগলেন পিতৃমাতৃহীন কনিষ্ঠকে। আদর করে ডাকতেন ‘ক্ষুদে’। ছোটবেলা থেকেই সে খুব অন্যরকম। কখনও দস্যি, কখনও বা শান্ত। অপরূপার স্বামী অমৃতলাল রায় তমলুকের হ্যামিল্টন হাই স্কুলে ভর্তি করে দিলেন ক্ষুদিরামকে।

স্কুলের চৌহদ্দিতেও ছোট্ট ক্ষুদিরাম বাকিদের থেকে অন্যরকম। সমকাল সম্বন্ধে সমবয়সীদের তুলনায় অনেকটা বেশি সচেতন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলন ক্ষুদিরামের মতো স্কুলের ছাত্রদের ভীষণ প্রভাবিত করেছিল। বিপ্লবী নেতা অরবিন্দ ঘোষ এবং সিস্টার নিবেদিতার আগুনে-কথাও ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছিল স্পর্শকাতর কিশোরটিকে।

বিদেশি অত্যাচারের কাহিনী শুনে স্থির থাকতে পারত না। সদ্য কিশোর যুক্ত হয়ে পড়লেন অনুশীলন সমিতির সঙ্গে। লক্ষ্য স্বাধীনতা আন্দোলনে সরাসরি যোগদান। লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেন না। কলকাতায় বারীন্দ্র কুমার ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ হল। বয়স তখন মাত্র ১৫! ওই বয়সেই হয়ে উঠলেন সক্রিয় স্বেচ্ছাসেবী।

একদিন ব্রিটিশ শাসন বিরোধী পুস্তিকা বিতরণের অপরাধে গ্রেপ্তার হলেন। সেই প্রথম কারাদর্শন। দেশের ডাক এবার স্কুলছুট করালো। পড়াশোনা ছেড়ে যোগ দিলেন গুপ্ত সমিতিতে। তাঁর নেতা সত্যেন বসু। একের পর এক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ। কখনও কৃষি ও শিল্পমেলায় রাজদ্রোহমূলক ইস্তেহার বন্টন আবার কখনও ডাকের থলিলুট।

এসব কাজের মধ্যেই ছটফটানি থেকেই যেত ভিতর ভিতর। তিনি যে অপেক্ষা করছিলেন বড় ডাকের জন্য।

খুব অপেক্ষা করতে হল না। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ও স্বদেশী আন্দোলনের কর্মীদের কঠোর সাজা ও দমননীতির কারণে কলকাতার প্রধান প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস কিংসফোর্ড অত্যন্ত ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন বিপ্লবীদের কাছে। অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হল ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকীর ওপর।

বিপ্লবীদের রোষের গন্ধ পেয়েই কিংসফোর্ডকে বদলি করে দেওয়া হয়েছিল #মুজাফ্ফরপুরে সেশন জাজ হিসেবে। কিন্তু বিপ্লবীদের হাত থেকে নিস্তার নেই তাঁর! ক্ষুদিরাম আর প্রফুল্ল পৌঁছে গিয়েছিলেন মুজাফ্ফরপুরে।

দিনটা ৩০ এপ্রিল। স্থানীয় ইউরোপীয় ক্লাবের গেটের কাছে একটি গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইলেন দু’জনে। অতর্কিত আক্রমণের জন্য। রাতের অন্ধকারে এগিয়ে এল একটা ফিটন। সঙ্গে সঙ্গে ধেয়ে এল বোমা। বিস্ফোরণে ছিটকে গেল গোটা গাড়িটা!

কিন্তু দুর্ভাগ্য!

ঘটনা যেমনটা ঘটার ছিল, ঠিক তেমনটা ঘটল না। সেদিন ওই গাড়িতে ছিলেন না কিংসফোর্ড সাহেব। ফিটনে ছিলেন মিস ও মিসেস কেনেডি। বোমার ঘায়ে নিহত হলেন।বিস্ফোরণের ঘটনায় পর ওয়ানি রেলস্টেশনে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন ক্ষুদিরাম। ২৫ মাইল পায়ে হেঁটে পৌঁছে ছিলেন স্টেশন। তাঁর বিরুদ্ধে সমন বেরিয়েছিল। বোমা-ছোঁড়ার সব দায় নিজের উপর নেন। বিচারে ফাঁসির আদেশ।

তার আগে যে ক’দিন কারাবন্দী ছিলেন কিশোর বিপ্লবী, তাঁর সব সময়ের সঙ্গী ছিল রবীন্দ্রনাথ, মাৎসিনী, গ্যারিবল্ডি। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও একইরকম। ভয়হীন। দ্বিধাহীন।

চারজন ইংরেজ পুলিশ উপস্থিত ছিলেন সেদিন। দেখে অবাক হয়েছিলেন। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কীভাবে এমন শিনা টানটান থাকতে পারে এতটুকু ছেলে! সরকারী খাতায় ক্ষুদিরামের বয়স তখন ১৮ বছর ৭ মাস ১১ দিন।

১৯০৮ সালের ১১আগস্ট, আজকের দিনেই দেশমায়ের সেবায় ফাঁসিকাঠে নিজেকে সঁপে ছিলেন তিনি। বাংলা জুড়ে সেদিন কান্নার রোল। হাসি মুখে ফাঁসিতে যাওয়া বাঙালি বীরের সাহসে মুগ্ধ হয়েছিল গোটা দেশ।

আজও অম্লান সেই মুগ্ধতা...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...