কালী কথা: খয়রা কালী মন্দির, চারশো বছর যাবৎ পূজিত হচ্ছেন দেবী

বাঙালির পরিচয় মাছ-ভাতে, প্রিয় খাদ্য মাছকে সে ভগবানের ভোগেও নিবেদন করে। শুধু তাই নয়, মাছের সাথে জড়িয়ে গিয়েছে মন্দিরের নামও। শোল মাছ আর তারাপীঠের কাহিনী আমাদের জানা। বড় বাজারের পুটে কালীর যেমন নাম হয়েছে পুঁটি মাছ থেকে, তেমনই আজকের কালী কথায় যার কথা বলব, তাঁর নামকরণ হয়েছে খয়রা মাছ বা খয়রা ইলিশ থেকে। তিনি খয়রা কালী। কিংবদন্তি বলে, এই কালীর বয়স সাতশো বছরেরও বেশি। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে বিথারি শ্মশানে কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কাশীনিবাসী ব্রাহ্মণ গোপাল সার্বভৌম। এই মন্দির শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের স্মৃতিধন্য। তিনি এখানে দু'বার এসেছিলেন।

কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটে বঙ্গের দিকপাল পণ্ডিত গোপাল সার্বভৌম চক্রবর্তী বেদপাঠ করছেন। বিশ্বনাথ দর্শনে যাওয়ার পথে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য গোপাল সার্বভৌমের বেদপাঠ শুনলেন।

মোহিত হয়ে গেলেন তিনি, রাজ্যাভিষেকের দিন গোপালকে যশোরে গিয়ে বেদপাঠের আমন্ত্রণ জানালেন। আমন্ত্রণ রক্ষা করতে যশোরে যাওয়ার পথে গোপাল সার্বভৌম নদীপথে অমাবস্যার রাতে জঙ্গলে পথ হারালেন। পথ হারিয়ে গোপাল সদলবলে হাজির হলেন বিথারিতে। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লেন গোপাল ও তার সঙ্গীসাথীর। সেই রাতে স্বপ্নাদেশ পেলেন গোপাল। তিনি দেখলেন এক দেবী সেখানে কালীমূর্তি তৈরি করে পুজোর নির্দেশ দিচ্ছেন। ঘুম থেকে উঠে সেই রাতেই কালীমূর্তি গড়ে পুজো করলেন গোপাল। পরদিন মূর্তি বিসর্জন করতে গিয়ে একের পর এক বাধা পেলেন। ঠাকুর বিসর্জন আর হল না। ফের দেবীর স্বপ্নাদেশ হল। স্বপ্নে দেবী গোপালকে বিথারিতেই বসবাস করতে বললেন, একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে নির্দেশ দিলেন। রাজা প্রতাপাদিত্য মন্দির গড়ে দেবেন।

যশোর রাজবাড়ি পৌঁছে সমস্ত অভিজ্ঞতার কথা রাজাকে জানালেন গোপাল। রাজা জমি ও অর্থ দান করলেন। প্রতিষ্ঠিত হল মন্দির। মন্দির সংলগ্ন স্বর্ণ নদী থেকে খয়রা মাছ ধরে মায়ের ভোগ দেওয়া শুরু হল। মুসলমান জেলেদের ধরা মাছেই দেবীকে অর্ঘ্য নিবেদন করা হত। বিথারি দেবী কালিকার নাম হয়ে গেল ‘খয়রা কালী’। মন্দিরের অনতিদূরেই রাণী রাসমণির জামাই মথুরমোহন বিশ্বাসের পৈতৃক ভিটে। বিথারি মথুরমোহনের জমিদারির অধীনে পড়ত। মন্দির রক্ষণাবেক্ষণে তিনি দান করতেন। রাণী রাসমণিও মন্দির সংস্কারের জন্য অর্থসাহায্য করেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ বিথারি কালীমন্দিরে এসেছেন, পুজো করেছেন। স্থানীয়দের বিশ্বাস এই মন্দিরের কালী মা অত্যন্ত জাগ্রত। একদা গোয়ালবাথান গ্রামে কলেরা মহামারির আকার নিল। এলাকার মানুষজন ভক্তিভরে দেবীর কাছে প্রার্থনা জানালেন। দেবীর কৃপায় কলেরার প্রকোপ কমল এবং সেই কলেরায় কারও মৃত্যু হল না।

বসিরহাটের স্বরূপনগরে সীমান্তবর্তী বিথারি গ্রামের খয়রা কালী মন্দিরে, প্রতি বছর অগ্রহায়ণ মাসের শেষ মঙ্গলবার প্রচুর মানুষজন পুজো দেন। সে দিন মন্দিরপ্রাঙ্গণে মেলা বসে। প্রতি বছর মাঘ মাসের চতুর্দশীর রাতে সাড়ম্বরে রটন্তীকালী পুজো হয়। সেদিন মাকে খয়রা মাছ রান্না করে দেওয়ার রীতি রয়েছে। কালীপুজোর দিন সাবেকি রীতিতে তন্ত্রমতে পুজো হয় আজও।

আরেকটি কিংবদন্তি বলে, প্রায় ৬০০ বছর আগে মোঘল সম্রাটের নির্দেশে অবিভক্ত পূর্ব বাংলার চাঁদড়া গ্রামের জমিদার বাড়ি যাওয়ার সময় বর্তমান মন্দিরের পিছনের বাঁওড়ের পাশে মায়ের স্বপ্নাদেশে মায়ের জোড়া মৃন্ময়ী প্রতিমাকে তান্ত্রিক মতে পুজো করেন গোপাল সার্বভৌম। তিনি মায়ের স্বপ্নাদেশ পান, সেই মতো একটি মূর্তি বিসর্জন দেওয়া হয়। অপরটিকে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে স্থায়ীভবে মায়ের নিত্য পুজো শুরু হয়। কালে কালে নাটমন্দির, বাগান সব তৈরি হয় মন্দির ঘিরে।

মথুরমোহন বিশ্বাস এবং তার স্ত্রী জগদম্বা এসেছিলেন এই মন্দিরে। মন্দিরের ভগ্নদশা দেখে রানিমাকে জানাতেই, রানিমা পাকা মন্দির নির্মাণ করেন এবং মায়ের প্রস্তুর মূর্তিও নির্মাণ করান। জানবাজারের নির্দেশেই মন্দিরের চারপাশে কুম্ভাকার, কর্মকার, স্বর্ণকার, কাহারের মতো বারোজীবি মানুষ থেকে শুরু করে মুসলমান সম্প্রদায়ের বাজনাদারেরাও বাস করেন। পুরনো রীতি মেনেই আজও কাহার সম্রদায়ের মানুষরাই মন্দির পরিষ্কার করে। অধুনা ট্রাস্ট তৈরি হয়েছে, তারাই মন্দিরের তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব রয়েছে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...