পাখির দেশ খিরসু

অবসর যাপন মানেই কিছু বাঙালির কাছে ভ্রমণ। কাছে দূরে প্রকৃতির সান্নিধ্যে অথবা রোজনামচায় স্বাদ বদলের জন্য বাঙালি বেরিয়ে পড়ে। আমরাও বেরিয়ে পড়ি পাহাড়ে সমুদ্রে যেখানে ইচ্ছে পকেটের রেস্ত বুঝে। রোজনামচার একঘেয়েমিকে কাটিয়ে ফেলার অব্যর্থ দাওয়াই ভ্রমণ। সঙ্গে নানা ভাষা , নানা জাতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার অদম্য কৌতূহল। পাউরি ছাড়িয়ে চলেছি খিরসুর উদ্দেশ্যে। 

আবার শুরু হল পাহাড়ি পথে চলা। দৃশ্যের পর দৃশ্য পরিবর্তন হয়ে চলেছে। আমাদের সঙ্গী কখনও ঘন জঙ্গল, নানা ধরণের  গাছ-গাছালি। রং-বেরঙ্গের ফুল প্রজাপতি। পাহাড়ি ঝরণা। দুরন্ত গতিতে বয়ে যাওয়া নদী। রুপোলি বরফে মোড়া পর্বতশিখড়। সবুজ গালিচায় মোড়া বুগিয়াল। আর একদিকে অতলস্পর্শী গভীর খাদ। আবার কখনও একের পর এক পর্বত। পাহাড় আর নানা রঙ্গের ভূপ্রকৃতি। বৈচিত্রময় প্রকৃতির রূপ আস্বাদন করতে করতে মন ও নানা রঙে রঙিন।

 

Khirsu1

 

পাউরি থেকে মাত্র ১৯  কিলোমিটার দূরে খিরসু। শহরের মতো ঘিঞ্জি নয়, একেবারে নীরব নিস্তব্ধ একটি জনপদ। খুব ছোট্ট জনপদ খিরসু। গাড়ি-ঘোড়া মানুষের কোলাহল নেই। হাজার হাজার পর্যটক সমাগম একেবারেই নেই। শব্দদূষণ-বায়ুদূষণ মুক্ত প্রকৃতির কোলে এক শান্ত নিস্তব্ধ জনপদ।   

পাইন, ফার, ওক, দেওদার, বার্চ গাছে ছাওয়া আর আপেল বাগানে ঘেরা ভীষণ শান্ত শহর খিরসু। মার্চ-এপ্রিল মাসে রোডোডেনড্রোন ফুলের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। প্রকৃতিতে লাগে হোলির রঙের ছোঁয়া। নাম না জানা কত পাখি আর তার কলতান, বিস্ময়াবিভূত হতেই হয়। বেলা যত বাড়তে থাকে দূরের আকাশে দৃশ্যমান হতে থাকে  গিরিশৃঙ্গরাজি। মাথায় বরফের তাজ নিয়ে একে একে বান্দরপুঁছ, শ্রীকন্ঠ, কেদারনাথ, সতোপন্থ, বদরিনাথ, নীলকন্ঠ, কামেট, দুনাগিরি, নন্দাদেবী, ত্রিশূল সবাই মেঘের রাজ্যে আসর জমিয়ে বসে।

 

Khirsu2

 

থাকার জায়গা G.M.V.N এর রেস্টহাউস। যথেষ্ট ভাল রুম। সেখানেই রয়েছে বিশেষ সুবিধাযুক্ত কটেজ। রেস্ত একটু বেশি খরচ করতে হবে। তবে  একান্তে বারান্দায় বসে সকাল সন্ধ্যাবেলায় যখন শৈলশিখরে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখব, পকেটের কথা মনেই পড়বে না। 

খিরসুর চারপাশে জঙ্গল। জঙ্গলে হিংস্র জানোয়ারও রয়েছে। খিরসুর রেস্টহাউস-এর চারিদিকে  সুরক্ষাবলয় হিসেবে দেওয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে। পাখির দেশ খিরসু। নানা রঙের রং বাহারি পাখির দেশ এই জনপদ। সারাদিন বসে নাম না জানা পাখির কলকাকলিতে মুগ্ধ হতেই হয়।

 

Khirsu3

 

কটেজের ভেতরের ব্যবস্থা খুব সুন্দর। বাইরে শক্ত এলুমিনিয়ামের দরজা। তবে হিংস্র জন্তুর কাছ থেকে কিন্তু নিরাপদেই থাকা যায়। কটেজগুলো মূল রেস্ট হাউস থেকে বেশ কয়েক ধাপ নিচে। প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা। একটিতে একটি পরিবার  ঠাঁই পেতে পারেন। বারান্দায় বসেই সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়। নিস্তব্ধ খিরসুতে কটেজগুলো আরও নিরিবিলি জায়গায়। প্রকৃতিকে উপভোগ করতে হলে আর প্রকৃতির সিম্ফনিতে হারিয়ে যেতে চাইলে খিরসুতে দুটো রাত কাটাতেই হবে। পূর্ণিমার রাত হলে  অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে সেই রাত। বিদ্যুৎবাতির অপ্রতুলতা রয়েছে, তাই তমসাছন্ন রাতে চাঁদের আলো, রুপোলি বরফের মুকুটের ঝলকানি, ঘন জঙ্গলের অতিপ্রাকৃত পরিবেশে পাহাড়ের রানী খিরসুর রূপে মুগ্ধ হতেই হবে। আর নির্মল প্রকৃতিতে অবগাহন করার উৎকৃষ্ঠ সুযোগ হাতে এলে হাতছাড়া করার উপায়ই নেই। 

শৈলরানী খিরসুতে খাবার-দাবারের অসুবিধা নেই তবে পাহাড়ি খানাতে মানিয়ে নিতে হবে। বাঙালি রন্ধনশৈলী প্রত্যন্ত খিরসুতে আশা করা বাতুলতা।

 

Khirsu4

 

অবকাশ যাপন শেষের পর্যায়ে এবার ফেরার পালা। খিরসু থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ল্যান্সডাউনের উদ্যেশ্যে। পাহাড়ের বৈচিত্রময় প্রকৃতি সঙ্গে নিয়ে ল্যান্সডাউন এসে পৌঁছে গেলাম  রাত্রিবাস করার জন্য। গাড়োয়াল রাইফেলস-এর সদর দপ্তর হওয়ায় এটি ক্যান্টনমেন্ট শহর। ভীষণ ছিমছাম। ছবির মতো শহর। চারিদিকে পাহাড়। ওক, পাইন, সিলভার ফার, রোডোডেনড্রোনে ঢাকা। কোলাহল নেই। শান্ত নির্জন। একেবারে ঝুলনের মতো সাজানো।

রাতটুকু কাটিয়ে পরের দিন ফেরার পথে টিফিনটপ, সেন্ট মেরি চার্চ দেখে কোটদ্বারের দিকে রওনা দিলাম। বিকেলের মধ্যে কোটদ্বার হয়ে পৌঁছে গেলাম হরিদ্বার। আবার একটি রাত্রিবাস পরেরদিন ট্রেন ধরার জন্য।

ধনৌলটি, পাউরি, খিরসু, ল্যান্সডাউন প্রত্যেকটি জায়গাই অপার সৌন্দর্যের ভান্ডার। গাড়োয়ালের ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম নাম যশ খ্যাতিতে পিছিয়ে, কিন্তু প্রকৃতির  অফুরন্ত  ভান্ডার নিয়ে  শীর্ষস্থানের তালিকায় রয়েছে এই অফ বিট স্পটগুলো। 

প্রকৃতির সিম্ফনিতে হারিয়ে যাই আমরা প্রকৃতির কাছে। কয়েকটা দিনের বিশ্রাম, অবকাশ যাপন তারপর ফের আবার ফিরে চলা শহরের টানে। পিছনে পড়ে থাকে হিমালয়। হাজার রঙের মিশেলে তৈরি জঙ্গলের ক্যানভাস আর রূপোর তাজ পরিহিত মৌন মুখর পর্বতশৃঙ্গের অতল আহ্বান। বোধ করি যুগযুগ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদেরই অপেক্ষায় । 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...