বাংলার লৌকিক দেবতা, ক্ষেত্ররক্ষক ক্ষেত্রপাল

বাংলার সমৃদ্ধ লৌকিক ইতিহাসে আমরা বিচিত্র বিচিত্র দেবদেবীর হদিশ পাই, যারা নিজেদের উপস্থিতি দিয়ে বাংলার লোকসংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। এমনই এক দেবতা হলেন ক্ষেত্রপাল; ক্ষেতরক্ষক, যিনি ক্ষেত রক্ষা করেন তিনিই ক্ষেত্রপাল৷ ক্ষেত্রপাল মূলত ভূমিরক্ষক এবং কৃষির লৌকিক দেবতা হিসেবেই বাংলায় পূজিত হয়ে আসছেন৷ ইনি সর্বভারতীয় দেবতা৷ মূলত ভৈরব মূর্তির এই দেবতাকে অনেকেই লৌকিক শিবের একটি রুদ্র রূপ হিসেবে কল্পনা করেন৷ ক্ষেত্রপাল কোথাও মূর্তির আকারে আবার কোথাও শিলার আকারে পূজিত হন৷ 
 
বহু দেব বহু মঠ না যায় কথন।
নীচ জাতি গৃহে দেখ ধর্ম সনাতন।।
ক্ষেত্রপাল মহাকাল প্রভৃতি দেবতা।
যাহার যেরূপ ভক্তি সেরূপ গঠিতা।।
 
ক্ষেত্রপাল হল দিকপাল দেবতা, আবার কোথাও কোথাও দিক পাল দেবতাদের ক্ষেত্রপাল বলা হয়। মধ্যযুগে রচিত বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য থেকে অনুমান করা যায় ক্ষেত্রপাল কোন একক দেবতা নন বা একজন নন। তিনি বিভিন্ন আকৃতি বা মূর্তিতে বিভিন্ন দেশের সকল দিক রক্ষা করেন। 
 
অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগে উত্তর ভারতের দশনামী শৈব সন্ন্যাসীরা যখন বাংলায় আসেন, তখন তারা তারকেশ্বরে অবস্থান করেন। তাঁদের ধর্ম প্রচারের জন্য কেন্দ্র ও শিবতীর্থ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময় বাংলায় প্রচলিত নানান লৌকিক দেব-দেবীর কথা তারা জানতে পারেন। সেই সব লৌকিক দেবতাদের কথা তারা তারকেশ্বর শিবতত্ত্ব গ্রন্থে উল্লেখ করেন।
 
ঐ গ্রন্থেই বাংলার লৌকিক দেবতা হিসেবে ক্ষেত্রপালের কথাও উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন যুগের সুদক্তি কর্ণামৃত-এ ক্ষেত্রপালের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই সব তথ্যই বলে দেয় যে, বাংলায় আড়াইশো- তিনশো বছর আগে ক্ষেত্রপালের পুজোর প্রচলন ছিল। তারকেশ্বর শিবতত্ত্ব অনুযায়ী, গ্রামের লোকেরা পশুবলি দিয়ে, পাথরে পুজো করে ক্ষেত্রপালের আরাধনা করে। ধর্ম ঠাকুরের পুজোতেও দিক-ক্ষেত্রপালদের পুজো করা হয়। 
 
"পূর্বে থাকিয়া এস গোরিয়া ক্ষেত্রপাল।
উত্তরে থাকিয়া এস কালিয়ে ক্ষেত্রপাল।।
পশ্চিমে থাকিয়া এস মহুদ্দি ক্ষেত্রপাল। 
দক্ষিণে থাকিয়া এস ঠাকুর দক্ষিণ রায়।।
ভাটিয়া আর শহরে তোমার পূজা হয়। 
তোমার মহিমা আমি কি বলিতে পারি।। 
ভোগে অধিষ্ঠান হও, হাজার অধিকারী।"
 
এই ছড়া পাঁচালি থেকে অনুমান করা হয় আঠার ভাটির পূজনীয় বাঘেদের দেবতা দক্ষিণ রায় আদপে একজন ক্ষেত্রপাল। তবে কোন এক কালে ক্ষেত্রপালের সঙ্গে দক্ষিণ রায়ের মিশ্রণ ঘটেছে বলেই অনুমান করা হয়। ব্রাহ্মণ পুরহিতেরা দক্ষিণ রায়কে, ক্ষেত্রপাল রূপে পুজো করেন। পুজোর সংস্কৃত ধ্যানমন্ত্রে, ক্ষেত্রপালের উল্লেখ পাওয়া যায়,
 
"ভ্রাজচ্চণ্ড জটাধরং ত্রিনয়নং নীলাঞ্জাদ্রি প্রভম
দোর্দণ্ডাভং গদা কপালমরুন স্রগগন্ধ বস্ত্রউজ্জ্বলম
বন্দেহ্ং সিত-সর্প-কুন্ডলং-ধরং। শ্রীক্ষেত্রপালংসদা।"
 
ক্ষেত্রপালের এই ধ্যানমন্ত্রের অর্থ 'উজ্জ্বল ভয়ংকরজটাধারী, ত্রিনয়ন, নীল কজ্জ্বল ও পর্বতসদৃশ প্রভাবিশিষ্ট, দুই হাতে ধৃত গদা ও কপাল, রক্তবর্ণমাল্য, গন্ধ ও বস্ত্রে উজ্জ্বল, কটিতে বদ্ধ ঘণ্টার ঘর্ঘরশব্দের ভীষণ ঝংকারে ভয়ংকর, সাদা সর্পের কুণ্ডলধারী ভগবান ক্ষেত্রপালকে আমি বন্দনা করি৷' এই দুটি বিবরণ অনুধাবন করলে ক্ষেত্রপালকে শিবের রূপান্তর বলে ধারণা হওয়া স্বাভাবিক৷ ক্ষেত্রপাল জটামণ্ডিত, ত্রিনয়ন, দিগম্বর৷ প্রথম বিবরণে বামহস্তে কপাল ও দ্বিতীয় হস্তে শক্তি, দ্বিতীয় বিবরণে তাঁর এক হাতে গদা ও অপর হাতে কপাল৷
 
Khetrapal1
 
দ্বিতীয় বিবরণে ক্ষেত্রপালের কর্ণে সাদা সাপের কুণ্ডল থাকে৷ এই বর্ণনার সঙ্গে শিবের সাদৃশ্য চোখে পড়ে৷ মৎসপুরাণের প্রতিমা বর্ণনায় পাওয়া যায় ক্ষেত্রপাল কুকুর শৃগালের দ্বারা সেবিত হন৷ শিব যে পশুপতি সেই পশুপতিত্বের ইঙ্গিত মেলে এখানে৷ শিবের সঙ্গে এই গভীর সাদৃশ্য থাকায় ক্ষেত্রপালকে শিবের মূর্তিভেদ বলে জ্ঞান করা হয়৷ ক্ষেত্রপালের গদা বিষ্ণুর কাছ থেকে গৃহীত৷ কিন্তু কপাল বা পানপাত্র অথবা ভিক্ষাপাত্র শিব ও কালীর সম্পত্তি৷
 
বিশ্বকোষ -এর চতুর্থ খণ্ড অনুযায়ী ক্ষেত্রপালের ৪৯টি ভেদের কথা জানা যায়৷ তারা যথাক্রমে - অজর, আপকুন্ত, ইন্দ্রস্ত্ততি, ঈড়াচার, উক্ত, উন্মাদ, ঋষিসূদন, ঋমুক্ত, লিন্তকেশ, ল্লিপক, একদংষ্ট্রক, ঐরাবত, ওঘবন্ধু, ঔষধীশ, অঞ্জন, অস্ত্রবার, কাল, খরুখানল, গামুখ্য, ঘণ্টাদ, ঙ্মনঃ, চণ্ডবারণ, ছটাটাল, জটাল, ঝঙ্গীবঃ, ঞড়শ্চর, টঙ্গপাণি, ঠাণবন্ধু, ডামর, চক্কাবর, লবর্ণি, তড়িদ্দেহ,  স্থির, দন্ত্তর, ধনদ, নত্তিক্তান্ত, প্রচণ্ডক, ফট্কার, বীরশঙ্খ, ভঙ্গ, মেঘাসুর, যুগান্তক, রৌহ্যক, লম্বৌষ্ঠ, বসুগণ, শূকনন্দ, ষড়াল, সুনামা, হংব্রুক৷
 
যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধির পৌরাণিক উপাখ্যানকে প্রণিধানযোগ্য ধরে বলা যায়, বাংলায় বৌদ্ধ আমলেও ক্ষেত্রপাল পুজোর প্রচলন ছিল। হয়ত তার আরও আগে থেকেই ছিল। বৌদ্ধ যুগে মহাযানী বৌদ্ধরা বাংলার যে কয়েকটি লৌকিক দেবতাকে তাদের দেবকূলে স্থান দিয়েছিল তাদের মধ্যে ক্ষেত্রপাল বিশেষ স্থান পায়।
 
বাংলার কোন কোন দুর্গম পল্লিতে পণ্ডাসুরের পুজোর প্রচলন রয়েছে। এই পণ্ডাসুরও একজন লৌকিক দেবতা। তিনি ইক্ষু চাষের দেবতা। আখ চাষি এবং গুড় ব্যবসায়ীরা ভক্তি সহকারে পণ্ডাসুরের পুজো করেন। আদপে পণ্ডাসুর হলেন একজন ক্ষেত্রপাল। কারণ পণ্ডাসুরের পুজোয় পৌরহিত্য করেন ব্রাহ্মণ পুরোহিত। ধ্যান ও মন্ত্রপাঠ একটু মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় পণ্ডাসুরও একজন ক্ষেত্রপাল। পণ্ডাসুরের মন্ত্র - "যজমানায় হিতারথায় গুড়বৃদ্ধি প্রদায়িনে। পৌণ্ডাসুর ইহাগচ্ছ ক্ষেত্রপাল শুভপ্রদ।।"
 
ক্ষেত্রপালের নির্দিষ্ট কোন মূর্তি নেই, সর্বত্র প্রতীকে এর পুজো হতে দেখা যায়। কাঁসার ঘট বা কলসি, একটি বাঁশ দন্ড এবং একটি থালার সাহায্যে ক্ষেত্রপালের প্রতীক অঙ্কন করা হয়। কোন কোন অঞ্চলে মাটির কলসি উপর বা পাশে একটি থালা স্থাপন করে ক্ষেত্রপালের প্রতীক স্থাপন করা হয়। চৈত্র সংক্রান্তির দিন ক্ষেত্রপালের বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। যদিও দোল পূর্ণিমার দিন থেকেই পুজো আরম্ভ হয়। পুজোর দিন সকালে পুরোহিত এবং বিশেষ ভক্তেরা বাঁশঝার থেকে একটি বাঁশ কেটে নিয়ে আসেন।
 
তারপর বাঁশের শাখা-প্রশাখাগুলো কেটে, বাঁশকে পুকুরে স্নান করানো হয়। এরপর বাঁশটিকে লাল কাপড়ে কীর্তন করতে করতে সারা গ্রাম প্রদক্ষিণ করা হয়। মাঙন নেওয়া হয়, গ্রাম প্রদক্ষিণ করার সময় ধর্ম নির্বিশেষে সকল গ্রামবাসী বংশদন্ডটিকে শ্রদ্ধা জানায়। প্রদক্ষিণ চলাকালীন পুরোহিতকে চাল ও দক্ষিনা দেওয়া হয়। গ্রাম প্রদক্ষিণ শেষে ক্ষেত্রপালের পুজোর স্থায়ী জায়গায় বংশদন্ডটি পুঁতে রাখা হয়। দশ দিন ওই দন্ডটিকে পুজো করার পরে, নিকটস্থ পুকুরে বংশদন্ডটিকে রেখে দেওয়া হয়। আবার চৈত্র সংক্রান্তির দিন তা পুকুর থেকে তুলে আনা হয়। ঐ দিন মহাসমারোহে পুজো করা হয়।
 
এই দিনের পুজোর ক্ষেত্রপালের স্থায়ী প্রতীক কলসি ও থালা বার করে, কলসি, থালা এবং বংশদন্ডের সমন্বয়ে ক্ষেত্রপালের স্থায়ী প্রতীক তৈরি করা হয়। গ্রামে এই প্রতীকেই ক্ষেত্রপালকে অর্ঘ্য নিবেদন করা হয়। পুজোয় নৈবেদ্য রূপে আমিষ ও নিরামিষ উভয় প্রকার দ্রব্য নিবেদন করা হয়। পুজোয় ক্ষেত্রপালের উদ্দেশ্যে চাল, দুধ এবং মিষ্টি দেওয়ার চল রয়েছে। কোন কোন জায়গায় পুজোতে মহিষ এবং ছাগল বলিও দেওয়া হয়। জবা বা অন্য লাল ফুল দিয়ে ক্ষেত্রপাল ঠাকুরের পুজো করা হয়।
 
কোন কোন পল্লি এলাকায় ক্ষেত্রপালের পুজো করা হয়। ব্রতিনীদের বিশ্বাস ক্ষেত্রঠাকুর কুল গাছে থাকেন। তাই কুল গাছও তার প্রতীক। ব্রতে নৈবেদ্য হিসেবে পায়েস ও ছাতু নিবেদন করা হয়। আবার কিছু কিছু এলাকায় ক্ষেত্রপালকে গোসাই নামেও অভিহিত করা হয়। বাংলায় নানান গ্রামে যে ক্ষেত্র ঠাকুর ও ক্ষেত্র ঠাকুরানী পুজো করা হয়, তারাও আদপে ক্ষেত্রপালেরই রূপভেদ।
 
মৎসপুরাণে বর্ণিত ক্ষেত্রপালের মূর্তির যে বিবরণ রয়েছে সেখানে, ক্ষেত্রপালকে জটামণ্ডিত ও বিকৃতানন করে নির্মাণ করার কথা বলা হয়েছে৷ ক্ষেত্রপাল দিগম্বর , জটিল , কুকুর ও শৃগাল বেষ্টিত , তাঁর মস্তক কেশসমাবৃত, বাম হস্তে কপাল, দক্ষিণ হস্ত অসুরনাশিনী শক্তি প্রদান করে। মঙ্গলকাব্যগুলিতে দেখা যায়, স্বয়ং শিব কৃষিকার্য করছেন৷ যজুর্বেদের শতরুদ্রীয় স্তোত্রে রুদ্রকে ক্ষেত্রপতি বলা হয়েছে৷ তন্ত্রশাস্ত্রে শিবের একটি নাম ক্ষেত্রপাল বা ক্ষেত্রেশ৷ সুতরাং ক্ষেত্রপাল যে শিবেরই রূপান্তর , তাতে সংশয় নেই৷ তথাপি কেউ কেউ ক্ষেত্রপালকে অনার্য দেবতা বলে সিদ্ধান্ত করেছেন৷
 
সদূক্তিকর্ণামৃত নামক সংস্কৃত কোষগ্রন্থে এবং কোনও কোনও মঙ্গলকাব্যে ক্ষেত্রপালের উল্লেখ পাওয়া যায়৷ কোনও কোনও স্থানে ধর্মরাজের পুজোয় চতুর্দিকের অধিপতি হিসেবে ক্ষেত্রপালের বন্দনা করা হয়৷ বৌদ্ধ মহাযানীদের মধ্যেও ক্ষেত্রপালের পুজো প্রচলিত ছিল৷ বর্ধমান জেলার পানাগড়, শ্যামসুন্দর ও ভাতার থানার কয়েকটি গ্রামে এখনও প্রচলিত ক্ষেত্রপাল পুজোর সুলুকসন্ধানও বলা যেতে পারে৷
 
বর্ধমান জেলার সর্বাধিক পরিচিত ক্ষেত্রপাল মন্দিরটি হল পানাগড় মিলিটারি ক্যাম্পের ক্ষেত্রপাল৷ ক্ষেত্রপাল মন্দিরে যেতে হলে দুনম্বর জাতীয় সড়ক ধরে দুর্গাপুর অভিমুখে পানাগড় মিলিটারি ক্যাম্পের তিন নম্বর গেট দিয়ে ঢুকতে হয়৷ এই গেটটি হাঁসুয়া গেট নামেও পরিচিত৷
 
১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাইশটি গ্রাম সরিয়ে দিয়ে তৈরি হয় পানাগড় মিলিটারি বেস ক্যাম্প তৈরি হয়েছিল৷ তদানিন্তন হাঁসুয়া গ্রামেই ক্ষেত্রপাল দেবতার অবস্থান ছিল৷ সেই সময় জমি অধিগ্রহণ করার প্রায় দু-বিঘা জায়গা জুড়ে থাকা মন্দির চত্বরটিকে বাদ দেওয়া হয়৷ হাঁসুয়ায় ক্ষেত্রপাল পুজোর সূত্রপাত কবে হয়েছিল তা সম্পূর্ণভাবে অনুমান নির্ভর৷
 
পুরুষানুক্রমে চলে আসা এই পুজোর আনুমানিক বয়স পাঁচশো বছরেরও বেশি৷ মন্দির খোলা থাকে সকাল ছ-টা থেকে রাত্রি সাড়ে আটটা পর্যন্ত৷ মোট চোদ্দো জন পুরোহিত আছেন এবং নিত্যপুজো হয় পালা করে৷ নিত্যপুজোয় নারকেল, ফল, মিষ্টি দেওয়ার রীতিই প্রচলিত৷ মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের শনি ও রবিবার এই মন্দিরের বিশেষ বাৎসরিক পুজো অনুষ্ঠিত হয়৷ শ্রাবণ মাসের সোমবারগুলিতে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়৷
 
বহু পুরনো একটি তেঁতুলগাছের নীচে ক্ষেত্রপাল মন্দিরটি অবস্থিত৷ ক্ষেত্রপাল এখানে প্রস্তরখণ্ড রূপে আছেন৷ প্রথমে ক্ষেত্রপালের অবস্থান ছিল খোলা আকাশের নীচে৷ বর্ধমান রাজপরিবারের পক্ষ থেকে ক্ষেত্রপালের মাথার ওপর একটি ধাতুনির্মিত ছাতার মতো ছাউনির ব্যবস্থা করা হয়৷ তারও বহু পরে মন্দির গড়ে উঠেছে৷
 
লোকবিশ্বাস মতে ক্ষেত্রপালের কাছে মানত করলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়৷ দেবতার আশিস পাবার আশায় ভক্তগণ মন্দিরে মানত করে মাটির ঘোড়া বাঁধেন৷ পরে আশা পূর্ণ হলে যে-কোনও একটি ঘোড়া খুলে পিতলের ঘণ্টা বেঁধে আসেন৷ মন্দিরসহ সমগ্র চত্বর জুড়ে চোখে পড়ে হাজার হাজার পিতলের ঘণ্টা৷ ক্ষেত্রপালের ধ্যানমন্ত্রে ঘণ্টার উল্লেখ আছে এবং বিশ্বকোষ ও প্রয়োগসার নামক তন্ত্রগ্রন্থে ক্ষেত্রপালের নাম 'ঘণ্টাদ ' থেকেই বোধ হয় এই ঘণ্টা বাঁধার রীতিটি এসেছে৷
 
অনেকেই ক্ষেত্রপালকে ঘণ্টাবাবা হিসেবে অভিহিত করেন৷ ক্ষেত্রপাল মন্দির চত্বরেই আছে কালী, তুলসী এবং গণেশ মন্দির৷ ক্ষেত্রপালের পাশাপাশি তাঁরাও মানত পূরণের অর্ঘ্য হিসেবে ভক্তদের কাছ থেকে ঘণ্টা পান৷ সেনাছাউনির সেনা আবাসিকরা ক্ষেত্রপাল দেবতাকে খুবই মান্য করেন৷ কোনও রেজিমেন্ট সেখান থেকে চলে গেলে একটি স্মারক তৈরি করে দিয়ে যান৷ এই এলাকায় সেনার তৈরি করা এমন বেশ কয়েকটি স্মারক চোখে পড়ে।​
 
ক্ষেত্রপাল হলেন এক ভৈরব, এমন জনশ্রুতিও রয়েছে। তাঁকে শিবের অনুচর বা শিবের পৃথক এক রূপভেদ বলেই মনে করা হয়। শিবের সঙ্গে ক্ষেত্রপাল মিশে গিয়েছেন, এমন প্রতীকেরও দেখা মেলে কয়েক জায়গায়। যেমন উত্তর ২৪ পরগনার খড়দহে এক অতি প্রাচীন ক্ষেত্রপাল মন্দির রয়েছে। ওই মন্দিরে যে শিবলিঙ্গ রয়েছে, তার উপরের অংশটি স্বভাবিক শিব লিঙ্গের তুলনায় কিছুটা দীর্ঘ। উপরের অংশ কিছুটা উন্মুক্ত। প্রচলিত বিশ্বাস মতে মনে করা হয়, শিব লিঙ্গের ঐ অংশটি ক্ষেত্রপালের প্রতীক এবং রুপোর পাত দিয়ে পরে ঐ অংশটির সঙ্গে শিবলিঙ্গকে সংযুক্ত করা হয়েছে।
 
এইভাবে একই প্রতীকে দুই দেবতা মিশে গিয়েছেন এমনটা খুব একটা দেখা যায় না। অনেকেই মনে করেন ক্ষেত্রপাল আসলে শিব বা শিবেরই আকৃতি ভেদ। খড়দহের ঐ মন্দির ক্ষেত্রপাল মন্দির নামেই পরিচিত। মন্দিরের সামনে শ্রী শ্রী ক্ষেত্রপাল বাড়ি লেখা দেখা যায়। মন্দিরে শিবরাত্রি উপলক্ষ্যে বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। সে সময় এবং দুর্গা পুজো চলাকালীন তিনদিন শিব লিঙ্গ থেকে ক্ষেত্রপালের অংশটি খুলে অন্যত্র রাখা হয়। এটাই প্রমান করে যে, ক্ষেত্রপালকে শিব বা শিবের ভিন্ন রূপ ভেদ বা নিদেন পক্ষে শাস্ত্রীয় দেবতা বলেও মনে করেন না পুরোহিতেরা। এই ক্ষেত্রপালের প্রতীক অংশটি সরিয়ে রাখার ঘটনা তা নিশ্চিত করে।
 
প্রাচীন যুগে ক্ষেত্রপালের প্রস্তর মূর্তি দেখা যেত। তাতে ক্ষেত্রপালের হাতে গদা দেখা যায়। হাতে গদা এবং ক্ষেত্রপালের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা থেকে অনুমান করা যায়, প্রাচীন যুগে ক্ষেত্রপালকে দিক রক্ষক দেবতা বলে গণ্য করা হত। কারণ গদা হল রক্ষকদের চিহ্ন। হয়ত এই গদাই পরবর্তী কালে পল্লি বাংলায় বংশদন্ডে রূপান্তরিত হয়েছে। আর্য এবং অনার্য ধর্মরীতির মিলনের ফলে তাদের সংস্কৃতির আদান-প্রদান হয়েছে। ক্ষেত্রপালের গদা কালক্রমে বংশদন্ডে রুপান্তরিত হয়েছে। ক্ষেত্রপাল লৌকিক দেবতায় পরিণত হয়েছে।
 
অনেক লোকসংস্কৃতি গবেষকদের মতে, শস্যদেবতা ক্ষেত্রপাল শাস্ত্রীয় দেবতাকূলে স্থান পেয়েছেন।  উত্তরবঙ্গে এবং অধুনা ওপার বাংলার চট্টগ্রামে ক্ষেত্রপালের পুজোর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এই অঞ্চলগুলিতে আজও একাধিক ক্ষেত্রপাল পুজো আয়োজিত হয়। বাঁশ পুজো, বৃক্ষ পুজো এবং শস্যদেবতার পুজো হয়। আজও তারা অশাস্ত্রীয় দেবতা। এই পুজো আর্যপূর্ব যুগের বলে মনে করা যায়। পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাবেই আর্যযুগ প্রভাবিত ক্ষেত্রপালের জন্ম হয়েছে। সংস্কৃতি ভাষায় মন্ত্রাদি রচিত হয়েছে। যদিও আদিমযুগের রীতিগুলি আজও অক্ষত থেকে গিয়েছে। এখনও ক্ষেত্রপাল পুজোর অঙ্গ হিসেবে প্রাচীন আচার অনুষ্ঠান, বলিদান সব কিছুই রয়েগিয়েছে। ক্ষেত্রপালের সঙ্গে বংশদন্ডটিও রয়ে গিয়েছে। কিন্তু আজ আধুনিককালের মহিমায় অনেক জায়গা থেকেই ক্ষেত্রপালের পুজো প্রায় বিলুন্ত হয়ে গিয়েছে৷

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...