কেশবচন্দ্র সেন এবং এক টালমাটাল বিয়ের ইতিহাস

পাত্রের বয়স তখনও আঠারো হয়নি। পাত্রী বারোর কোঠায়। পাত্র রাজপুত্র। নেশা শিকার। পাত্রীর পিতাকে সারা কলকাতা এক ডাকে চেনে। সংস্কারমুক্ত, উদার, প্রগতিশীল, শিক্ষায়-দীক্ষায় সেকালের সেরা পরিবারদের অন্যতম।
তবু এমন 'রাজযোটক' বিয়ে নিয়েই ধুন্ধুমার বেঁধেছিল কলকাতায়। লোকের মুখে মুখে ফিরেছিল বিয়ের কাহিনী 'বিশ্বাস ভঙ্গের' কাহিনী হয়ে।
পাত্রের নাম যুবরাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণ। কন্যা সুনীতি। পিতা কেশবচন্দ্র সেন।
কেশবচন্দ্রের নাবালিকা কন্যার বিয়ে ঘিরে ঝড় বয়ে গিয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায়। ঘরে বাইরে বিপর্যস্ত ব্রাহ্ম আন্দোলনের পুরোধা পুরুষ।
পদে পদে অপমান বিয়ে ঘিরে।তবু তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অনড়।
কোচবিহার রাজবাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব যায় কলকাতার কেশব চন্দ্রে সেনের কাছে। তাঁর বড় মেয়ে সুনীতির সঙ্গে রাজপুত্র নৃপেন্দ্রনারায়ণের বিবাহ।
পাত্র-পাত্রী দুজনের বয়স বিয়ের আইনী বয়সের তুলনায় কম। যে আইন প্রবর্তনের জন্য তাঁর লড়াইও কম ছিল না, সে আইন নিজেই ভেঙেছিলেন কেশবচন্দ্র। রাজপরিবারে মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব ফেরাননি তিনি। ক্ষোভের সূত্রপাত সেখান থেকেই। ব্রাহ্ম সমাজ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল এই বিয়েকে ঘিরে।

কেমন ছিল ঐতিহাসিক এবং বিতর্কিত সপ্তপদী সন্ধেটি তার বিবরণ পাওয়া যায় সেদিনের কেশবকন্যার আত্মজীবনীতে। মহারাণী সুনীতি দেবীর ‘অটোবায়গ্রাফি অফ অ্যান ইণ্ডিয়ান প্রিন্সেস’ বইতে। কোনও ভারতীয় নারীর ইংরেজি ভাষায় লেখা প্রথম প্রকাশিত আত্মজীবনী।
বিয়ের শুরু থেকেই ব্রাহ্ম- হিন্দু বিবাদ মাথাচাড়া দিয়েছিল দুই পরিবারের ভিতর। রাজপরিবার থেকে জানানো হয় বিয়ের অনুষ্ঠান হবে হিন্দু মতে। কেশবচন্দ্র যেহেতু কালাপানি পার হয়েছিলেন বিলেত যাত্রা হেতু তাই তিনি কোনওভাবেই কন্যা সম্প্রদান করতে পারবেন না। তিনি যে জাতিচ্যুত। বিবাহ দেবেন হিন্দু পুরোহিতরা।
বিয়ের প্রথা নিয়ে নানারকম মত বিরোধ চলতে থাকে। বিয়ের দিন সন্ধেতে পরিস্থিতি এতটাই চরমে ওঠে যে একসময় বিয়ে প্রায় বাতিল হয়ে যাওয়ার জোগাড়। কন্যা লগ্ন ভ্রষ্টা হবে। এদিকে ঝামেলা মতান্তরের জেরে বিয়ের আসর থেকে দূরে সরে থাকেন কেশব চন্দ্র। পরিস্থিতি সামলাতে মেয়েমহল থেকে কেশবচন্দ্রের স্ত্রীকেও ব্যস্ত হতে হয় বিয়ের আসরে। দুশ্চিন্তার কালো মেঘে হারিয়ে গিয়েছে কন্যার বিয়ের আনন্দ। কোচবিহার রাজমাতার জেদের মুখে পড়তে হয় তাঁকেও। তিনি চেয়েছিলেন বিয়ের কিছু অনুষ্ঠান ব্রাহ্ম মতে হোক। কিন্তু জানিয়ে দেওয়া হয় সে পথে চললে সুনীতি রানীর মর্যাদা পাবেন না।
শেষ পর্যন্ত রাত তিনটের লগ্নে বিয়ে স্থির হল। কেশবচন্দ্রও এলেন। পাত্র-পাত্রীর ডাক যখন পড়ল তখন দেখা গেল যুবরাজ ঘুমিয়ে কাদা।
কোনওরকমে বিয়ে হয়ে গেল। বাজনা, বাদ্যি আলোর জৌলুস কোথায় কী! অনুষ্ঠান জুড়ে কেবল আশঙ্কার দমচাপা দীর্ঘশ্বাস!
অনেকের মতেই এই বিয়ে ছিল ইংরেজদের ঔপনিবেশবাদের এক কৌশল। তরাই এলাকার কোচবিহার আর পাঁচটা অঞ্চলের থেকে ভৌগলিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে আলাদা। ইংরেজরা চেয়েছিল এই অঞ্চলকে তাদের মতো করে তুলতে।
কেশবচন্দ্র চেয়েছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মের বিস্তার। তাই সমস্ত সমালোচনা অগ্রাহ্য করে রাজী হয়ে গিয়েছিলেন দ্বাদশ বর্ষীয়া নাবালিকা কন্যার বিয়েতে। কিন্তু ধর্ম প্রচার তাঁর সেই কৌশল বাস্তবে খুব কাজে দেয়নি।
ব্রাহ্ম সমাজের আন্দোলনে যিনি ছিলেন তরুণদের কাছে মুক্ত ভাবনার 'প্রফেট' তাঁর এমন অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে বড় ধাক্কা খান তাঁর অনুগামীরা। ভেঙে যায় কেশবচন্দ্র সেনের ব্রাহ্ম সমাজ। তৈরি হয় নতুন দল। তবে মহারাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণ নববিধান ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তাতেও আটকানো যায়নি হিমালয়ের পতন। কেশবচন্দ্রের ব্রাহ্মসমাজ নিয়ে স্বপ্ন আর কখনও সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি জনমানসে। স্ববিরোধী কার্যের জন্য যেন আচমকাই ধূলিসাৎ হয়ে গেল তাঁর গোটা ইমারত।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...